শরীরের ওজন কিছুটা বেড়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় ডায়েট কন্ট্রোল অথবা ব্যায়াম। হুট করে শুরু করা ডায়েট স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা আমরা ভুলে যাই। ঠিক তেমনি হুট করে কিছুদিন ব্যায়াম করে ছেড়ে দিলে ওজনের কোনো পরিবর্তন আসে না। ওজন কমানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা আর ধৈর্য। ডায়েট ও ব্যায়াম করা উচিত সঠিক নিয়ম মেনে। আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। আচ্ছা, বাড়তি ওজন কমানোর জন্য সহজ কোনো পন্থা আছে কি? আমরা জানি, যেকোনো খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে মসলা। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি ওজন কমাতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাই ফিট ও স্লিম থাকতে আপনার ডায়েটে যোগ করুন সেই ৮টি মসলা বা হার্বস। বাড়তি ওজন কমানোর জন্য কোন হার্বগুলো কার্যকরী, সেই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
বাড়তি ওজন কমানোর উপায়
অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য ওয়ার্ক আউট বা ব্যায়ামের পাশাপাশি খাদ্যতালিকাতেও নজর দিতে হবে। রেগুলার খাবারে আমরা যেই মসলাগুলো ব্যবহার করে থাকি, সেগুলো যে শুধু খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ বৃদ্ধি করে, তা কিন্তু নয়! এসব মসলা বা হার্বসের আছে নানান গুণ যেগুলো আমাদের অনেকেরই অজানা। শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষভাবে সহায়তা করে এই হার্বগুলো।
যে ৮টি মসলার ব্যবহার ওজনকে রাখবে আপনার কন্ট্রোলে
১) হলুদ
হলুদে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি প্রোপার্টি। হলুদ উষ্ণ মশলা যা শরীরের তাপ বৃদ্ধি করে এবং মেটাবলিজমকে বুস্ট করে। ইউরোপীয় জার্নাল অব নিউট্রিশনে বলা হয়, হলুদে থাকা কারকিউমিন উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস এবং শরীরের মেটাবলিক অ্যাকটিভিটি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৯ সালে টাফটস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক কিছু ইঁদুরের উপর গবেষণা করেন। কিছু ইঁদুরকে নিয়মিত কারকিউমিন দিয়েছে, আবার কিছু ইঁদুরকে কারকিউমিন দেওয়া হয়নি। এই ট্রায়ালের রেজাল্টে দেখা গেছে; যে ইঁদুরগুলো কারকিউমিন খেয়েছে, সেগুলোর ওজন হ্রাস পেয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফলই বলে দিচ্ছে বাড়তি ওজন কমানোর জন্য হলুদ কতটা উপকারী।
যেভাবে হলুদ খেতে পারেন
১। নিয়মিত টারমারিক চা পান করতে পারেন। এক বা দুই কাপ পানি গরম করুন। বলগ আসলে এতে হলুদের আস্ত ছোট টুকরো দিয়ে দিন। এর সাথে দারুচিনি যুক্ত করতে পারেন। ভালোভাবে ফুটিয়ে নামিয়ে ফেলুন। কুসুম কুসুম গরম অবস্থায় পান করুন।
২। প্রতিদিনের রান্নায় হলুদ ব্যবহার করুন।
৩। আপনি হলুদ দুধও পান করতে পারেন। মিডিয়াম আঁচে দুধ জ্বাল দিন। দুধ গ্লাসে ঢালুন, তারপর এর সাথে সামান্য হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। এটি নিয়মিত পান করুন।
২) দারুচিনি
রান্নায় বহুল ব্যবহৃত একটি মসলা হলো দারুচিনি। দারুচিনি পেটের অতিরিক্ত মেদ কমাতে সাহায্য করবে। দারুচিনি কার্বোহাইড্রেইড খাওয়ার আগ্রহ কমায়, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে এবং দীর্ঘসময় ধরে পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে ওয়েট লসের জার্নিটা বেশ সহজ হয়ে যাবে! দারুচিনির এই গুণগুলো আগে জানা ছিল না, তাই না? বাড়তি ওজন কমানোর জন্য এই হার্বটি ডায়েটে রাখতে ভুলবেন না!
যেভাবে দারুচিনি খেতে পারেন
১। ওটস, টকদই আর দারুচিনি গুঁড়া মিশিয়ে সকালে নাস্তা করতে পারেন। এটি বেশ হেলদি একটি ব্রেকফাস্ট মেন্যু, যা ওজন কমাতে হেল্প করবে।
২। প্রতিদিনের রান্নায় দারুচিনি ব্যবহার করতে পারেন। গুঁড়ো করে রেখে ডেজার্ট আইটেমের সাথেও ইউজ করতে পারবেন।
৩। দারুচিনি চা হতে পারে আপনার নিত্যদিনের সঙ্গী। সাথে একটু মধু ও লেবুর রস মিলিয়ে নিলে স্বাদ দারুণ হবে।
৩) জিরা
গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিনের খাবারের সাথে এক টেবিল চামচ জিরা যুক্ত করলে, তিনগুণ বেশি হারে মেদ হ্রাস হয়। জিরাতে থাইমোকুইন নামক উপাদান রয়েছে; যাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি প্রোপার্টিজ আছে। থাইমোকুইন শরীরের টক্সিন পদার্থ দূর করে, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর ওজন কমাতেও দারুণ হেল্পফুল।
যেভাবে খাবেন
১। জিরা পানি খেতে পারেন। দুই টেবিল চামচ জিরা পানিতে জ্বাল দিন। ভালোভাবে জ্বাল দিয়ে পানি কমে আসলে নামিয়ে ফেলুন। এটি দিনে দুইবার পান করুন। সকালে খালি পেটে পান করলে দ্রুত রেজাল্ট পাবেন।
২। প্রতিদিনের রান্নায় গোটা জিরা বা জিরা গুঁড়ো ব্যবহার করতে পারেন। যেকোনো গ্রেভি জাতীয় খাবার বা তরকারি রান্নার পর একটু জিরা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলে খাবারের স্বাদ বেড়ে যায়।
৪) আদা
আদার স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি। আদায় রয়েছে জিঞ্জারলস এবং শোগোল নামক উপাদান, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। বাড়তি মেদ কমানোর পাশাপাশি গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা কমাতেও আদা বেশ ভালো কাজ করে।
যেভাবে খেতে পারেন
১। আদা চা অথবা আদা পানির সাথে লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এটি আপনার শরীরকে হাইড্রেটেড রাখার পাশাপাশি বাড়তি ওজন কমানোর জন্যও কাজ করবে।
২। ওজন কমাতে গ্রিন টির সাথে আদা কুঁচি মিশিয়ে পান করতে পারেন। এটি তলপেটের অতিরিক্ত মেদ কমাতে দারুণ কার্যকরী। প্রতিদিন এই চা পান করলে ওজন কমানোর গতি ত্বরান্বিত হবে।
৫) রোজমেরি
রোজমেরি বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও সুপার শপে পাওয়া যায়। এটি বডির মেটাবলিক রেট বৃদ্ধি করে। সেই সাথে এটি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। রোজমেরিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি প্রোপার্টিজ, যা বাড়তি ওজন কমানোর জন্য খুব দ্রুত কাজ করে।
যেভাবে রোজমেরি খেতে পারেন
১০ আউন্স অথবা ২৯৫ মিলি পানি গরম করুন। এর সাথে ১ চা চামচ রোজমেরি দিয়ে দিন। কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়ার পর নামিয়ে ফেলুন। মধু মেশাতে পারেন। রোজমেরি চা প্রতিদিন পান করুন।
৬) এলাচ
সুগন্ধযুক্ত এই হার্বটি খাবারের ঘ্রাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আপনার ওজন হ্রাস করতেও সাহায্য করবে। এলাচিতে থার্মোজেনিক নামক উপাদান রয়েছে, যা মেদ কমাতে সাহায্য করে এবং পেটে গ্যাস তৈরিতে বাঁধা দেয়।
যেভাবে এলাচ খেতে পারেন
১। এক গ্লাস পানিতে এলাচ গুঁড়ো মিক্স করে সারারাত রেখে দিন। পরের দিন সকালে খালি পেটে এটি পান করুন।
২। দুইটা এলাচ গুঁড়ো করে নিন। এক গ্লাস দুধে মেশান, সরাসরি পান করুন।
৩। মসলা চা বানিয়ে নিতে পারেন এলাচ দিয়ে।
৭) গোলমরিচ
গোলমরিচে পাইপারিন নামক উপাদান রয়েছে, যেটি এতে ভিন্ন স্বাদ বা ফ্লেবার যুক্ত করে। স্বাদ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এটি চর্বি কোষ বা ফ্যাট সেল গঠনে বাধা দেয়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
যেভাবে খেতে পারেন
প্রতিদিনের খাবারে গোলমরিচ ব্যবহার করা যায়। ডিম পোচ, সটেড ভেজিটেবল, স্যুপ সবকিছুর সাথেই গোলমরিচের গুঁড়ো ইউজ করা যেতে পারে। সেদ্ধ পাস্তার সাথে সবজি মিলিয়ে গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে পারেন। আবার চিকেন বা ফিস রান্নায় গোটা মসলা ব্যবহার করা যায়।
৮) লালমরিচ
প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহৃত এই মশলাটি ওজন কমাতে বেশ কার্যকর। লালমরিচ শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা মেটাবলিজমকে বুস্ট করে। যত বেশি মেটাবলিজম শরীরে জেনারেট হয়, তত বেশি ক্যালরি বার্ন করে। তবে অতিরিক্ত গুঁড়ো মসলা ব্যবহার করলে হজমে সমস্যা হতে পারে। পরিমিত পরিমাণে মসলা ব্যবহার করতে হবে।
যেভাবে খেতে পারেন
প্রতিদিনের রান্নায় লালমরিচ ব্যবহার করুন, এটি খাবারের ১০০ ক্যালরি পর্যন্ত বার্ন করবে।
তাহলে জেনে নিলেন তো, বাড়তি ওজন কমানোর জন্য ডায়েটে কোন হার্বগুলো যোগ করতে হবে! এগুলো কিন্তু আমাদের হাতের কাছেই থাকে, উপকারিতা না জানার ফলে আমরা হয়তো এগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারি না। আজকের আর্টিকেল থেকে কিছুটা হলেও ধারণা পেয়েছেন আশা করি। ওজন কন্ট্রোলে রাখতে হেলদি লাইফস্টাইল মেনটেইন করবেন, তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলবেন এবং পরিমিতভাবে শারীরিক পরিশ্রম করবেন যাতে ক্যালরি বার্ন হয়। তাহলে আজ এই পর্যন্তই। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের প্রতি যত্নশীল হোন।
ছবি- সাটারস্টক, হেলথলাইন.কম