যেকোনো দম্পতির জন্য সন্তান ধারণ করা আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের নাম। সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে বন্ধ্যাত্ব নামক অভিশাপের কারণে। বন্ধ্যাত্ব কথাটি শুনলেই মনে হয় এটি শুধুমাত্র একজন নারীর সমস্যা, আসলে কিন্তু তা নয়! বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটি হতে পারে পুরুষদেরও। ইনফার্টিলিটির ৪০% ক্ষেত্রে এটি পুরুষের প্রজনন ক্ষমতায় সমস্যা থাকার কারণে হয়ে থাকে। আজকের লেখায় পুরুষদের ইনফার্টিলিটি বিষয়ে জেনে নেয়া যাক বিস্তারিত। যারা বেবি নেওয়ার ট্রাই করছেন বা বন্ধ্যাত্ব সমস্যা নিয়ে ভুগছেন, আজকের আর্টিকেলটি তাদের জন্য হেল্পফুল হবে।
পুরুষদের ইনফার্টিলিটি কাকে বলে?
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে বন্ধ্যাত্ব কাকে বলে। এটি নারী বা পুরুষ যেকোনো একজনের অথবা উভয়ের সমস্যার কারণে হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এক বছর স্বামী-স্ত্রী কোনো প্রকার গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা ছাড়া শারীরিক মেলামেশা করার পরেও যদি সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন তাহলেই তাকে বন্ধ্যাত্বতা বা ইনফার্টিলিটি বলে। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব তখনই বলা হয় যখন কোনো দম্পতির মধ্যে স্ত্রীর সন্তান ধারণের সকল গুণাবলি বা সক্ষমতা থাকা স্বত্বেও পুরুষের জনন্তান্ত্রিক সমস্যার কারণে কনসিভ করতে ব্যর্থ হন।
লক্ষণসমূহ কী কী?
- অপরিমিত বীর্যপাত বা স্বল্প পরিমাণে বীর্যপাত
- দৈহিক মেলামেশায় অনীহা
- টেস্টিস ফুলে যাওয়া, ব্যথা, টিউমার বা দলা জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব বুঝতে পারা
- অস্বাভাবিক স্তন বৃদ্ধি বা গাইনাকোমাস্টিয়া
- পরীক্ষায় প্রতি এম.এল. সিমেনে ১৫ লক্ষের কম বা প্রতি বীর্যপাতে ৩৯ লক্ষের কম স্পার্ম কাউন্ট
পুরুষদের ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্বের কারণ
১) কখনও কখনও বংশগত কিছু রোগের কারণে পুরুষদের ইনফার্টিলিটি দেখা দেয়। যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্লিয়েনফেল্টার সিন্ড্রোম, থ্যালাসেমিয়া, টাইপ-১ ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
২) আনহেলদি লাইফস্টাইল ইস্যু যেমন অতিরিক্ত তামাক সেবন, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়া এগুলো কিন্তু ইনফার্টিলিটির একটি বড় কারণ।
৩) নেশা জাতীয় দ্রব্য যেমন কোকেইন, ইয়াবা, গাজা, মদ্যপান ইত্যাদির অত্যাধিক ব্যবহার। কোকেইন, গাজা অত্যাধিক ব্যবহারে স্পার্ম কাউন্ট এবং স্পার্ম এর মান উভয়ই কমে যায়।
৪) ঔষধপত্র যেমন অতিরিক্ত স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন। যারা এখন জিম করেন এবং বডি বিল্ডিং এর জন্য ইনজেক্টেবল স্টেরয়েড ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব তৈরি হতে পারে।
৫) এছাড়াও অতিরিক্ত এংজাইটি বা অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ঔষধ সেবন, ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ সেবনেও স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়।
৬) পেশাগত বিভিন্ন কারণ যেমন যারা প্রতিনিয়ত এক্স-রে বা রেডিয়েশন এর সামনে থাকেন, লেড বা অন্যান্য ভারী ধাতুর কারখানায় কাজ করেন, বিভিন্ন রকম বিষাক্ত কেমিক্যাল বা সার কারখানায় কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
৭) অণ্ডকোষ বা টেস্টিস এর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে স্পার্ম প্রোডাকশন কমে যায়। অনেকেই আছেন যারা তলপেটের ওপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করেন এতে টেস্টিস এর তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
৮) বিভিন্ন মেডিকেল কন্ডিশন যেমন টেস্টিকুলার টিউমার, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, ক্রোমোজোমাল ডিফেক্ট, ইনফেকশন, জন্মগত জননাঙ্গের ত্রুটি, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা ধ্বজভঙ্গ ইত্যাদি কারণেও ইনফার্টিলিটি দেখা দিতে পারে।
৯) কোনো প্রকার অ্যাক্সিডেন্ট বা ট্রমার কারণে টেস্টিস অথবা জননাঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে ইনফার্টিলিটি দেখা দিতে পারে।
পরীক্ষা নিরীক্ষা
বিভিন্ন রকম পরীক্ষার মাধ্যমে পুরুষদের ইনফার্টিলিটি নির্ণয় করা যায়। যেমন,
১) সিমেন অ্যানালাইসিস- এই পরিক্ষার মাধ্যমে স্পার্ম কাউন্ট, স্পার্ম এর গুণগত মান ইত্যাদি বোঝা যায়।
২) টেস্টিকুলার বায়োপসি- সিমেন অ্যানালাইসিসে স্পার্ম কাউন্ট শুন্য বা কম থাকলে তখন এই পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে দুটি লক্ষ্য সাধন হয়, স্পার্ম এর অস্বাভাবিকতা নির্ণয় এবং আই ভি এফ চিকিৎসার জন্য স্পার্ম সংগ্রহ করা।
৩) হরমোনাল প্রোফাইল- স্পার্ম প্রোডাকশন এ বিভিন্ন রকম হরমোন প্রয়োজন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন হরমোনের সঠিক মাত্রা বের করা যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেও জননাঙ্গের অস্বাভাবিকতা নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
- স্পার্ম কাউন্ট কম থাকলে হরমোনাল থেরাপির মাধ্যমে স্পার্ম কাউন্ট বৃদ্ধি করা যায়।
- ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আই ভি এফ) পদ্ধতি এখন ইনফার্টিলিটি চিকিৎসার সবচেয়ে জনপ্রিয় পন্থা। এর মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলন ঘটানো হয়।
- উৎপাদন থেকে শুরু করে বীর্যপাত পর্যন্ত শুক্রাণুর যাত্রাপথের কোথাও কোন বাঁধা থাকলে তা অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করা যায়।
- নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহারের অভ্যাস থাকলে সে অভ্যাস ত্যাগ করা উচিৎ।
কখন হবেন চিকিৎসকের শরণাপন্ন?
প্রায় ২৫% ক্ষেত্রে পুরুষদের ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্বের সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটি এমন একটি রোগ যার ঘরে বসে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, তাই উপরে উল্লেখিত যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। বর্তমানে বিভিন্ন রকম হারবাল এবং কবিরাজি চিকিৎসার সয়লাব দেখা যায়, এসবে বিশ্বাস করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবে না! বরং দেরি করার কারণে এবং ভুল চিকিৎসায় অনেক সময় নিরাময়যোগ্য সমস্যাও স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। মেডিকেল সাইন্স অনেক দূর এগিয়েছে, উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
সময় থাকতে সচেতন হোন এবং লজ্জা ভুলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সন্তান না হওয়ার জন্য একতরফাভাবে স্ত্রীকে দোষারোপ করবেন না, সবার প্রথমে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্বের সঠিক কারণ খুঁজে বের করুন। আজকে তাহলে এই পর্যন্তই, শুভ কামনা সকলের জন্য।
ছবি- সাটারস্টক