সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা অবস্থানের জারিজুরি - Shajgoj

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা অবস্থানের জারিজুরি

tumb

সামাজিক অবস্থান বা সোশ্যাল স্ট্যাটাস বলে একটা জিনিস আছে, যা আমাদের সমাজে আরো বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক অবস্থান কোন বিষয়গুলোর ভিত্তিতে মাপা হয়? সমাজে কার কতটুক ক্ষমতা, যশ, খ্যাতি আর বৈভব, এগুলোই ঠিক করে দেয় ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান। হাল আমলে এই অবস্থান তৈরি হচ্ছে সমাজের ক্ষুদে সদস্যদেরও। কলেজপড়ুয়া শেষ কৈশোরের মেয়েটি তো বটেই, সদ্য কিশোর হওয়া স্কুলের বাচ্চা ছেলেটিও নিজের সোশ্যাল স্ট্যাটাস নিয়ে ব্যাপক সচেতন। আর তাদের এই স্ট্যাটাসটা কোন মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে? তাদের এই অবস্থান খুব ব্যাপক আকারে ডালপালা মেলছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট- হচ্ছে তাদের সামাজিক অবস্থান দেখানোর প্ল্যাটফর্ম। হতাশাজনক হলেও কথাটা সত্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আছে ছোট থেকে বড় সকল শ্রেণীর মানুষ। বয়স, শিক্ষা নির্বিশেষে সবার কাছে সহজলভ্য ইন্টারনেট দুনিয়ার এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আর এই সহজলভ্যতার কারণেই এগুলোকে ঘিরে অবস্থান দেখিয়ে বেড়ানোর রীতি চালু হয়েছে এত ব্যাপকভাবে।

[picture]

মাকে ‘মাম্মা’ আর বাবাকে ‘পাপা’ বলে সম্বোধন করে যে কিশোরী মেয়েটি পরিবারের ছবি আপলোড করেছে ফেসবুকে কিংবা ইনস্টাগ্রামে, সে বাস্তব জীবনে নিজের বাবা-মাকে হয়তো ‘আব্বা’ আর ‘আম্মা’ বলে ডাকছে। যেটা তার পছন্দ নয়। তার ঐ শব্দগুলো ভালো লাগছে না, অথচ সে সরাসরি বাবা-মাকে তার প্রিয় সম্বোধনে ডাকতে পারছে না, তাই সে নিজের পছন্দের সম্বোধন নিয়ে এলো সামাজিক মাধ্যমে! এখানে সে ভীষণ অভিজাত পরিবারের আদরের মেয়েটা! নিজের মনমত সামাজিক অবস্থান তৈরি করাটা এখন কত সহজ, দেখলেন তো?

কলেজে যাওয়া ছেলেটা দারুণ গানবাজনা করে বেড়ায়। প্রোফাইল ভরা তার গিটার বাজানোর ছবিতে। কিছু টুকরো অডিও ক্লিপ আপলোড দিয়ে বন্ধুদের সাথে নিজের কাজগুলো ভাগাভাগি করে মাঝেমধ্যে। অথচ সত্যি এই যে, ছেলেটি কখনো গান গাইবার কথা চিন্তাই করেনি! কিন্তু এই পরিচয়টা বেশ স্টাইলিশ। ভালোই তো লাগে নিজেকে এভাবে ভাবতে, সবার কাছে পরিচয় দিতে। তো চলুক না, ক্ষতি কী?

কিংবা, তরুণী বৌটি তার স্বামীর দেয়া উপহার বা জিনিসপত্রের ছবি প্রায়ই আপলোড করে ফেসবুকে। বড়লোক স্বামী ভদ্রলোক বৌকে দিয়েও যাচ্ছেন দামী সব সামগ্রী। সেসব জিনিস ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবাইকে তো বটেই, বিভিন্ন গার্লস গ্রুপে পোস্ট দিয়ে জনসাধারণকে না দেখালে মেয়েটি শান্তি পায় না। কখনো যদি বেশ অনেকদিন নতুন জিনিস না পায় সে, ফেসবুকে ছবি না থাকা পুরনো জিনিসপত্রও “মাত্র পাওয়া উপহার” নাম দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে! কেননা ঘনঘন নিজের নতুন পোশাক, গহনা বা সাজসজ্জার উপকরণের ছবি পোস্ট করে সবাইকে জানানো তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন জিনিস পাওয়া তাই বন্ধ হতে পারে, কিন্তু নতুন জিনিসের ছবি পোস্ট করা বন্ধ হওয়া চলবে না। এই চোখ ধাঁধানো স্ট্যাটাসটা একবার গড়ে নিলে সহসা ছাড়া কি সম্ভব? মেয়েটিও তাই যখন খুশি মিথ্যা গল্প বানিয়ে নিচ্ছে। অটুট থাকছে তার এই সামাজিক অবস্থান!

লেখকের তকমা গায়ে সেঁটে টুকটাক খ্যাতি কুড়নো যুবক/যুবতীর ফলোয়ার লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। তার লেখা ছোট কবিতাগুলো আজকাল অনেকের ছবির ক্যাপশন হিসেবেও দেখা যায়। লেখায় ধার আছে বটে! ক্রমবর্ধমান ভক্তদল নিয়ে সে ভীষণ খুশি। এরই মাঝে হুট করে জানাজানি হলো, দিনের পর দিন অন্যের প্রোফাইল ঘেঁটে তাদের লেখা কপি করে এই মানুষটা নিজের নামে চালিয়ে এসেছেন! লেখার আসল মানুষগুলো হয়তো এই অনলাইন জগতে নিভৃতচারী খুব, লেখক সাহেব/সাহেবা সেই সুযোগটাই নিয়ে চলেছেন এতদিন। চমকে উঠতে হয় বৈকি, এমন একটা মানুষ যদি নিজের বন্ধুতালিকায় থাকে যার লেখা নিয়ে সত্যিই মুগ্ধতা কাজ করতো।

খোলামেলা পোশাকের ছবিতে ইন্সটাগ্রাম ভরপুর। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট, কাঁধখোলা জামা, আরো কতকিছু! সাহসী বলেই গণ্য করা হয় মেয়েটাকে। হবে না কেন, মফস্বল শহরে বাস করেও যে তার এমন চলার ধরণ! বাস্তবে মেয়েটা সাদামাটা সালোয়ার-কামিজেই নিত্যকার জীবন কাটায়। ধূমপান সে আজ অবধি করে নি সত্যিই। কখনো কখনো বাইরে যেতে মাথায় ঘোমটাও দেয় সে। পারিবারিক শিক্ষার দান ওগুলো। তাই বলে অনলাইনে কেন সে অন্য রকম হবে না? কেন সে তার পছন্দের রূপে মানুষের চোখে ধরা দেবে না? এগুলো কিছু কঠিন তো নয়!

এই মিথ্যা পরিচয়ের গল্প ফাঁদা আজকাল খুব সহজ ব্যাপার। এমনকি ধরা পড়লেও জবাবদিহি করার দায় নেয় না এই মানুষদের অনেকেই। তারা অন্ধ তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস নিয়ে, যা কিনা সত্যিকার অর্থে তাদের নয়! তাই যারা অনলাইনেও বাস্তব চিত্র ধরে রাখা মানুষ, যারা একটাই জীবন যাপন করছে সর্বক্ষেত্রে, তাদের আরো বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সতর্কতা প্রয়োজন এই কারণে, যেন এমন একটা মিথ্যা চরিত্রের সাথে কোনো প্রকার লেনদেনে না জড়াতে হয়। যারা নিজেদেরকেই মিথ্যা গল্পের চরিত্র বানিয়ে রেখেছে, তারা খেয়াল খুশিমত যে কাউকে যেকোনো বিষয়ে বিব্রতও করতে পারে। আর যারা অনলাইনে নতুন পা রাখা মানুষ, তাদের দরকার বাড়তি সাবধানতা। বিশেষ করে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ সদস্য কেউ অনলাইনে এলে তাকে এটুকু জানিয়ে দেয়া উচিত, এই দুনিয়ার অনেকটুকুই ফাঁকি। তাই নতুন মানুষদের সাথে পরিচয় করার বেলায় খুব সাবধান!

লিখেছেন- মুমতাহীনা মাহবুব

0 I like it
0 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort