ফুড পয়জনিং বা ঘন ঘন পেট খারাপ হলে কী করবেন?

ফুড পয়জনিং বা ঘন ঘন পেট খারাপ হলে কী করবেন?

372512

আমরা অনেকেই মনে করি বমি হলে বা পেট ব্যথা করলেই ফুড পয়জনিং হয়েছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। পেট ব্যথার অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। ফুড পয়জনিং মূলত দূষিত খাবার গ্রহণের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত রাস্তা বা হোটেলের বাসি-পচা খাবার, অস্বাস্থ্যকর ও জীবাণুযুক্ত খাবার, নষ্ট হয়ে যাওয়া ফলমূল ইত্যাদি খেলে ফুড পয়জনিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর কোন কোন কারণে ফুড পয়জনিং হয় এবং প্রতিরোধের উপায় কী, চলুন জেনে নেই।

ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ

দূষিত খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই খাদ্যজনিত অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেয়। দূষণ এর উৎস ভেদে ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে কিছু লক্ষণ প্রতি ক্ষেত্রে প্রায় একই থাকে।

  • বমি বমি ভাব ও অস্বস্তি লাগা
  • বার বার বমি হওয়া
  • পানিযুক্ত পাতলা পায়খানা বা পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া
  • পেট কামড়ানো বা পেটে ব্যথা
  • জ্বর জ্বর ভাব

ফুড পয়জনিং

কারণ ও উৎস

সংক্রামক জীবাণু যেকোনো সময় খাদ্যকে দূষিত করতে পারে। খাদ্য প্রস্তুত করা, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ যেকোনো স্টেজে ক্রস কন্টামিনেশন (Cross Contamination) হতে পারে। এক উৎস থেকে অন্য উৎসে জীবাণু ছড়ানোকে ক্রস কন্টামিনেশন বলে। খাবার যদি ভুলভাবে প্রসেস করা হয় বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করা হয় তবে বাড়িতেও কিন্তু এই দূষণ হতে পারে। বিশেষ করে কাঁচা বা রেডি টু কুক খাবার যেমন বিভিন্ন রকম সালাদ, ফলমূল ঠিকমতো না ধুয়ে অথবা মাংস উচ্চ তাপে রান্না না করে খেলে ক্ষতিকারক জীবাণুগুলো ধ্বংস হয় না এবং খাবারে বিষক্রিয়া ঘটায়।

বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা পরজীবী এজেন্ট খাদ্যে সরাসরি বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এগুলোর থেকে যেকোনো একটি এজেন্ট আপনার খাবারে থাকলে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন-

ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার (Campylobacter)

এটি সাধারণত পাকস্থলীতে পাওয়া যায়। এটি শরীরে প্রবেশ করার ২-৫ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ করে। এর উৎস কাঁচা মাংস ও পোলট্রি ফিড। মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ এর সময় যদি প্রাণীর মল সেই মাংসের সংস্পর্শে আসে তাহলে এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে দূষিত হয়। এছাড়াও অপাস্তুরিত দুধ বা দুধ জাতীয় পদার্থ এবং দূষিত পানির মাধ্যমেও এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়।

ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম (Clostridium Botulinum)

এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্তের ১২-৭২ ঘন্টার মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। টিনজাত খাবার বা প্রসেসড ফুড, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে সেদ্ধ করা আলু, আধা সেদ্ধ বা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা কাঁচা মাছ, উষ্ণ তাপমাত্রায় সংরক্ষিত খাদ্য ইত্যাদিতে এই ব্যাকটেরিয়া গ্রো করে।

টিনজাত খাবার বা প্রসেসড ফুড

ই-কোলাই (Escherichia Coli)

মল দ্বারা দূষিত গরুর মাংস, কম তাপে রান্না করা গরুর মাংস, অপাস্তুরিত দুধ, কাঁচা সবজি, দূষিত পানি ইত্যাদিতে ই-কোলাই থাকে। ই-কোলাই শরীরে প্রবেশের ১-৭ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে। এর ফলে ডায়রিয়ার সাথে রক্তও যেতে পারে।

হেপাটাইটিস এ

হেপাটাইটিস এ হলো একমাত্র সাধারণ খাদ্যবাহিত রোগ যা ভ্যাকসিন দ্বারা প্রতিরোধ করা যায়। এটি পাঁচটি হেপাটাইটিস ভাইরাসের একটি যা লিভারকে সংক্রমিত করে। এটি লিভার ফেইলিউর এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ যা মল-মূত্রের মাধ্যমে ছড়ায়।

এছাড়াও Rotavirus, Salmonella, Shigella ইত্যাদি দিয়েও ফুড পয়জনিং হয়। মূলত কাঁচা মাংস, ডিমের কুসুম, ডেট এক্সপায়ার্ড ব্রেড ও বেকারি আইটেমস, অল্প তাপে সেদ্ধ বা রান্না খাবারে এসব জীবাণু থাকে। খাবার প্রস্তুতকারীর অপরিচ্ছন্ন হাত, ছুরি, থালা বাসনের মাধ্যমেও জীবাণু ট্রান্সফার হয়ে শরীরে প্রবেশ করে।

ডেট এক্সপায়ার্ড ব্রেড

কাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে?

নরমালি ফুড পয়জনিং হলে ১/২ দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারা কারা ঝুঁকিতে আছে, চলুন দেখে নেই-

১) প্রবীণ ব্যক্তি

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। সংক্রামক জীবাণুর বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকরভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম কাজ করতে পারে না, তাই রোগের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

২) গর্ভবতী নারী

গর্ভাবস্থায় শরীরের মেটাবলিজমে ও সার্কুলেশনে অনেক রকম পরিবর্তন আসে। সে সময় ফুড পয়জনিং এ আক্রান্ত হলে গর্ভাবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়ে। অনেক সময় শরীরে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয় যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর।

৩) ছোট শিশু

শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি ডেভেলপ হয় না, তাই ফুড পয়জনিং এর প্রভাব ক্ষতিকর হতে পারে। আর ছোট্ট শিশুদের এমনিতেই সব কিছু মুখে দেওয়ার টেন্ডেন্সি থাকে। আবার সব খাবার শিশুদের হজমও হয় না। এসব কারণে বাচ্চাদের ঘন ঘন পেটের সমস্যা দেখা দেয়।

ফুড পয়জনিং

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন- ডায়াবেটিস, এইডস, লিভার ডিজিজ বা ক্যান্সার এর রোগী যার কেমোথেরাপি চলছে, এদের জন্য ফুড পয়জনিং অনেক সময় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পেট খারাপ হলে কী খাবেন?

যারা অলরেডি ফুড পয়জনিংয়ে ভুগছেন, তাদের কী কী খাওয়া উচিত আর কোন কোন খাবারগুলো বাদ দেওয়া উচিত; চলুন দেখে নেই তাহলে-

১) ফুড পয়জনিং হলে মসলা ও ঝাল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। তেলে ভাজা খাবার বা ফ্রায়েড আইটেম না খাওয়া-ই ভালো। দুধ, ডিম খেলেও এই সময়ে হজমে সমস্যা হতে পারে।

২) ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রতিবার টয়লেটের পর স্যালাইন খেতে হবে। অবশ্যই সঠিক নিয়মে স্যালাইন বানাতে হবে এবং ১২ ঘন্টা অতিবাহিত হলে বানানো স্যালাইন ফেলে দিন।

৩) সল্ট ব্লাড প্রেশার বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে সেটা আরও বিপজ্জনক। যাদের হাই ব্লাড প্রেশার আছে, তারাও স্যালাইন খাবেন তিন বেলা। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা প্রেশারের মেডিসিন রেগুলার খেতে হবে। ব্লাড প্রেশার মনিটর করুন। যদি অসুস্থবোধ করেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৪) চিড়া-কলা, কাঁচকলা ভর্তা দিয়ে নরম ভাত, কম তেল মসলা দিয়ে রান্না করা সবজি বা চিকেন, ভেজিটেবল স্যুপ, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে হবে।

ফুড পয়জনিং হলে ডাবের পানি

ফুড পয়জনিং প্রতিরোধের উপায়

  • খাবার তৈরির আগে এবং খাবার খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত, বাসন ধুতে হবে
  • কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে
  • সঠিক তাপমাত্রায় খাবার রান্না করতে হবে
  • রান্না করা খাবার ভালোভাবে সেদ্ধ হয়েছে কিনা তা খেয়াল করে দেখতে হবে
  • খাবার ফ্রিজে সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করতে হবে
  • ফ্রিজে কাঁচা মাছ-মাংস এবং রান্না করা খাবার এক সাথে পাশাপাশি রাখা যাবে না
  • রান্না করা খাবার ঢেকে রাখতে হবে যাতে মাছি না বসে
  • কোনো খাবার নষ্ট হয়ে গেছে বা গন্ধ বের হচ্ছে এমন হলে সেটা সাথে সাথে ফেলে দিতে হবে
  • রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলুন
  • বাইরে থেকে এসে হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করুন

করণীয়গুলো দেখে নিন এক নজরে

  • আক্রান্ত হলে ডাবের পানি, স্যালাইন, চিড়া ভেজানো পানি, কাঁচকলা সেদ্ধ ইত্যাদি খাওয়া শুরু করতে হবে
  • ঘন ঘন পেট খারাপ হলে বাইরের তেলে ভাজা অস্বাস্থ্যকর খাবার, জুস এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে
  • হাই ব্লাড প্রেশার থাকলেও ডিহাইড্রেশন এড়াতে স্যালাইন খেতে হবে
  • বেশি তেল মসলা যুক্ত খাবার বাদ দিয়ে সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে
  • পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে পান করতে হবে

ফুড পয়জনিং রোধে নিজের সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। অবস্থা বেশি খারাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু রোগীর বেলায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। হেলদি ফুড সিলেকশনের মাধ্যমে আপনি ফিট থাকতে পারেন সহজেই। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

 

ছবি- সাটারস্টক

10 I like it
6 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort