সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে বলার আগে একটা ঘটনা শেয়ার করবো আপনাদের সাথে।
তমা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছে। গোটা পৃথিবীটা এলোমেলো লাগছে!! বাথরুম থেকে গোসল সেরে লেমন বেশ হাসিখুশি মুডে বের হলো। গুনগুন করে হালকা সুর বাজাচ্ছে। তমাকে খেয়াল না করেই ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার সামনে দাঁড়ালো।
আজ অনেকদিন পর কণার সাথে দেখা হবে! দুপুরে একসাথে খাবার কথা,আজ কি রেঁধেছে কে জানে! পাগলী একটা! প্রায়ই নতুন কিছু রেঁধে ওকে চমকে দেয়! খাবার সময় পাশে বসে খুব যত্ন করে খাওয়ায়। একটু পর পর জিজ্ঞেস করে, “এই বলো না, রান্না কেমন হলো?”
লেমন ভালো না হলেও খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, “খুবই চমৎকার! বহুদিন এতো ভালো খাই না।“
“কেন? তোমার বউ রাঁধে না!”
“দূর!! ওর রাঁধার সময় আছে! ঘরেতো বুয়া রান্না করে!”
গত মাসে কণা তার হাজব্যান্ডের সাথে দেশের বাইরে গিয়েছিলো। গতকাল ফিরেছে, আজ দেখা করতে যাবে। সকাল থেকেই অদ্ভুত ভালো-লাগায় হৃদয়টা ভরে আছে। লেমন হঠাৎ একটু জোরে গেয়ে উঠলো, “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ুরের মতো নাচেরে…!”
তমা ফোনটা নিয়ে লেমনের হাতে দিয়ে বললো, “কণা ফোন করেছিলো! কে এই কণা?”
লেমন হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল! আমতা আমতা করে বললো, “আমার অফিসের কলিগ! তোমার সাথে কি কথা হয়েছে? আমার ফোন কেন ধরেছো?”
তমা খুব ঠান্ডা একটা লুক দিয়ে বললো, “মিথ্যা বলার দরকার নেই। তোমার ম্যাসেনজার, টেক্সট… সব পড়েছি! তোমাকে পাঠানো ওর অর্ধনগ্ন ছবিও দেখেছি! তোমাদের শারিরীয় ভাষার কথোপকথন পড়তে ঘৃণা লাগছিলো,তবুও পুরোটা শেষ করলাম। কতদিন ধরে এসব চলছে?”
লেমন আর ভনিতা করলো না, করার সুযোগও নাই। মাথা নিচু করে জবাব দিলো, “চার বছর।“
তমা একটু কেঁপে উঠলো, চার বছর ধরে অন্য একটা সম্পর্ক বহন করে চলছে, একদিনও টের পায় নি! বারো বছর ধরে সংসার করছে, অথচ কোনদিন কিছুই মনে হয় নি!!
প্রায় চার বছর প্রেম করে বাবা মায়ের অমতে লেমনকে বিয়ে করেছে। লেমন খুব একটা পরিশ্রমি ছেলে নয়, কাজ করতে ভালো লাগে না। তাই সংসারের দায়িত্বটা তমাই নিয়েছিলো। আটটা পাঁচটা চাকরী করে সংসারের সব কাজ নিজ হাতেই করতো।
প্রথম বাচ্চাটা হবার পর লেমন একটা চাকরী নিলো। ভালোভাবে অফিসে যেতো না বলে সেটাও টিকলো না। তমাই এক্সট্রা ইনকামের জন্য টিউশনি করাতো!
তবুও সংসার চলছিলো।দ্বিতীয় বাচ্চাটা কিছুতেই নিতে চায় নি তমা। লেমন জোর করেছিল, কথা দিয়েছিল, এবার সংসারের হাল সে ধরবে।
সত্যিই তাই করেছিল লেমন! একটা বড় অফিসে চাকরী শুরু করলো। বেশ বড় অংকের বেতন। অফিসের কাজে প্রায়ই বিদেশ ট্যুরে যেতে হয়, রাতারাতি অনেক কিছুই বদলে গেল!
প্রায় জোর করেই তমার চাকরীটা ছাড়তে বাধ্য করলো লেমন!
গত দু’বছর ধরে তমা ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে বেশ গুছিয়ে সংসার করছে। যদিও এ জীবন তার কাছে অসহনীয় তবুও সন্তানদের কথা ভেবে, লেমনকে ভালোবেসে এক জীবন কাটানো যায়! ভালোই তো ছিল এই অন্ধ জীবন!
কেন যে ফোনটা ধরতে গেলো! তমার কেমন দমবন্ধ লাগছে।খুব ক্লান্ত লাগছে… ক্লান্ত হলে চলবে না। আজ প্রশ্ন করতেই হবে, জানতেই হবে! কেন? কেন?
লেমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই কেন-এর কোন জবাব নেই। ও নিজেও জানে না, কেন? কিভাবে কণার সাথে জড়িয়ে গেল! অফিসে বসের জন্মদিনের পার্টিতে ওর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল।
একটা লাল রঙের শাড়িতে! কণাই এগিয়ে এসেছিল, কথা বিনিময়ে ফোন নম্বরও বিনিময় হয়েছিল। বসের বউ জানা সত্ত্বেও একটুও ভয় করে নি, খুবই আপন মনে হয়েছিল! কণার কল্যাণেই চাকরীতে খুব দ্রুত ভালো করছিল লেমন! অফিসে লোকজন ফিসফাস করে বটে কিন্তু সামনাসামনি সবাই ওকে সমীহ করে চলে।
লেমন চুপ করে আছে। কোন জবাব দেবার নেই। কী করে তমাকে বিশ্বাস করাবে, এই সংসার, তমা,ছেলে-মেয়ে সবই ওর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ, ও কাউকে ছাড়তে চায় না! কণাকেও ওর দরকার, ওর ভালো থাকার, বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে! কী জবাব দিবে ও?
তমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো।পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, চারপাশটা খুব অন্ধকারে ছেয়ে আছে, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! এত বিশ্বাস কী করে করেছিলো? কী করবে তমা?
বাবা মা বিয়েটা মেনে নেয় নি,তাই যোগাযোগটাও ভালো নেই। গত কয়েক বছর ধরে সংসার সামলাতে এতো ব্যস্ত ছিল যে, কোন বন্ধুবান্ধবও আর নেই, কারো নামও মনে পড়ছে না!
দু’বছর ধরে চাকরী নেই। নতুন একটা চাকরী যোগাড় করা সহজ নয়। এতই বোকা যে, ব্যাংকে টাকা জমানোর কথাও মনে হয় নি, গহনার প্রতি লোভ ছিল না তাই সোনার তেমন কিছুই নেই!
দুটো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাবে? তাছাড়া ছোট মেয়েটা লেমনের ভক্ত। ছেলেমেয়ে দুটো বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না, ওদের কী অপরাধ! আলাদা থাকার প্রশ্নই আসে না! অন্যদের শত প্রশ্নের কী জবাব দিবে তমা?
তমার সারা শরীর ঘৃণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে…চার বছর! অনেক লম্বা সময়! নিজেকে এত অসহায়, এত নীচ আগে কখনো লাগে নি!!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রিয় পাঠক! এটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। তমা এখন সাইকো থেরাপি নিচ্ছে,আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।
এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে। মনে রাখা প্রয়োজন, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না!
সম্পর্কগুলো এক একটা চারাগাছ,যত্ন প্রয়োজন। অযত্নে কখন কোথায় ফাটল ধরে আমরা টেরও পাই না! তাই পারস্পরিক আলোচনা খুব জরুরী, বিশ্বাসের সাথে যুক্তির আলোচনাও মুক্তি এনে দেয়!
জেনে নেই সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে গবেষণা কী বলছে?
সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে গবেষণা বলছে, ৬০% দাম্পত্য জীবনে অন্তত একজন পার্টনার অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে যায় এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়!
সম্পর্কের টানাপোড়েন : মানুষ কেন প্রেমে পড়ে?
এর তিনটি কারণ-
১. আমিতো প্রেমে পড়ি নি,প্রেম আমার উপর পড়েছে
আমাদের ব্রেইন-এ কিছু কেমিক্যাল রিলিজ হয়, যা আমাদের নতুন রোমান্স তৈরি করতে সাহায্য করে। যখন কাউকে দেখে আমাদের ভিতরে পজিটিভ ভাবনা তৈরি হয়, ভালো-লাগা বোধ হয়, তখন ব্রেইন-এ ডোপামিন, নর এপিনেফরিন এবং সেরোটোনিন নি:সরণ হয় এবং প্রেমের বানে ভাসতে বলে।
২. প্রশংসা চাই, External validation
মানুষ প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে, এটি তার সহজাত বৈশিষ্ট্য! দীর্ঘ দিনের দাম্পত্য জীবনে পরস্পরকে ভালো লাগার কথা বলতে অনেকেই ভুলে যান,সময় পান না! এই সব ফাঁকফোকরে যখন অন্য কেউ আপনার গুণের, রূপের, কথার মূল্যায়ন করে, তখন আসলে আপনি তার নয়, অনুভূতিটার প্রেমে পড়েন।
Falling in love with this new, wonderful image of themselves, an image that’s receiving praise.
৩. আমি মানুষ,
আমার কেন পাখির মতো মন
তিন নম্বর কারণটা মানুষের সহজাত কিনা জানি না! মানুষের মন কেবল উড়তে চায়, ঘুরতে চায়, দেশ দেশান্তরে! তাই তার থাকে দ্বৈত জীবন, প্যারালাল ওয়ার্ল্ড। বাস্তবের বাইরে তার অন্য জীবনে যে মানুষের ছবি আঁকে, যে মানুষকে সাজায় ভালোবাসার রঙে,তার সাথে যদি দৈবাৎ দেখা হয়ে যায়,তবে মনকে আটকানো কঠিন বৈকি!
Falling in love with FANTASY image.
রবী ঠাকুর বলেন,
“এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়?
সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।“
কারণ যাই হোক, নতুন প্রেমে জড়ানোর আগে এক ধাপ পিছনে আসুন, ভাবুন, নিজের ভিতরের নিজেকে আবিষ্কার করুন। সম্পর্কের টানাপোড়েন যাতে না হয় সেই চেষ্টা করুন।
প্রেমের কাহিনী গান
হয়ে গেলে অবসান।
এখন কেহ হাসে
কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।।
লিখেছেন- উম্মে শায়লা রুমকী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিটিআরসি।
ছবি- সংগৃহীত: সাটারস্টক