ফাইব্রোমাইলজিয়া, নামের মতোই একটি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শুধু শারীরিক ব্যথাই নয়, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা, মেজাজ পরিবর্তন এবং স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা সহ অনেক উপসর্গ অনুভব করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ এই রোগে ভুগছেন, তবে এটি প্রায়শই ভুল নির্ণয় বা অবহেলিত হয়ে থাকে।
ফাইব্রোমাইলজিয়া কী?
ফাইব্রোমাইলজিয়া একটি স্নায়বিক অবস্থা যা ব্যথার সংকেত প্রক্রিয়াকরণে পরিবর্তন ঘটায়। কীরকম? সাধারণত, আমরা শরীরের কোথাও ব্যাথা পেলে স্নায়ুতন্ত্র ব্যথার সংকেত মস্তিষ্কে পাঠায়, কিন্তু ফাইব্রোমাইলজিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে, এই সংকেতগুলি বর্ধিত হয়ে যায় – ফলে সাধারণ স্পর্শও অত্যন্ত বেদনাদায়ক হতে পারে।
তবে জটিলতা হলো এই রোগ কোনো ধরনের প্রদাহ বা টিস্যু ক্ষতি সৃষ্টি করে না, তাই এক্স-রে বা রক্ত পরীক্ষায় এটি ধরা পড়ে না। এই কারণে, অনেক সময় রোগীর অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যা রোগীদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়।
ফাইব্রোমাইলজিয়ার প্রধান উপসর্গসমূহ
ফাইব্রোমাইলজিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলি হল:
সারা শরীরে ব্যথা: এই ব্যথা সাধারণত শরীরের উভয় পাশে এবং শরীরের উপরের ও নিচের অংশে অনুভূত হয়। একটি বিশেষত্ব হল ব্যথা “চলাফেরা” করে – এক জায়গায় শুরু হয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়।
চরম ক্লান্তি: ঠিকঠাক ঘুম হওয়া সত্ত্বেও দেখা যায় রোগীরা প্রায়শই সারাদিন অবসাদগ্রস্ত বোধ করেন। এই ক্লান্তি সাধারণ কাজকর্ম করাকেও কঠিন করে তোলে।
ঘুমের সমস্যা: অনেক রোগী গভীর ঘুমে যেতে পারেন না, ঘন ঘন জেগে উঠেন বা ঘুম থেকে উঠার পরও অস্বস্তি বোধ করেন।
মনোযোগের সমস্যা: “ফাইব্রো ফগ” নামে পরিচিত এই অবস্থায় মনোযোগ দেওয়া, মনে রাখা এবং সাধারণ কাজ করাতেও সমস্যা হতে পারে।
অন্যান্য উপসর্গ: মাথাব্যথা, পেট খারাপ, ব্লাডার সমস্যা, উৎকণ্ঠা এবং বিষণ্ণতা প্রায়শই দেখা যায়।
ফাইব্রোমাইলজিয়ার কারণ ও ঝুঁকি
বিজ্ঞানীরা এখনও ফাইব্রোমাইলজিয়ার সঠিক কারণ নির্ধারণ করতে পারেননি, তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে:
জেনেটিক উপাদান: পরিবারে অন্যদের ফাইব্রোমাইলজিয়া থাকলে আপনার ঝুঁকি বেশি থাকে।
শারীরিক বা মানসিক আঘাত: গুরুতর দুর্ঘটনা, সার্জারি, মানসিক চাপ বা দীর্ঘকালীন মানসিক যন্ত্রণা ফাইব্রোমাইলজিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
সংক্রমণ: কিছু সংক্রামক রোগ ফাইব্রোমাইলজিয়া তৈরি করতে পারে।
পুরুষদের তুলনায় নারীদের ফাইব্রোমাইলজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সাধারণত ৩০-৫০ বছর বয়সের মধ্যে রোগ নির্ণয় করা হয়।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
ফাইব্রোমাইলজিয়া নির্ণয় করা চ্যালেঞ্জিং, কারণ এর উপসর্গগুলি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে মিলে যায়। ডাক্তাররা সাধারণত অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলি বাদ দেওয়ার পর বেদনাদায়ক স্থানগুলি পরীক্ষা করে এটি নির্ণয় করেন।
চিকিৎসা পদ্ধতি
ওষুধ: ব্যথা কমাতে প্রদাহ-বিরোধী ওষুধ, ঘুমের সমস্যা কমাতে ঘুমের ওষুধ, এবং বিষণ্ণতা বা উৎকণ্ঠা কমাতে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট।
শারীরিক থেরাপি: নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন সাঁতার কাটা বা হাঁটা- পেশীর শক্তি বাড়াতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
মানসিক সহায়তা: কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) রোগীদের ব্যথার সাথে মোকাবিলা করতে এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে মোকাবিলা
ফাইব্রোমাইলজিয়া সঙ্গে বসবাস করা চ্যালেঞ্জিং, তবে আপনার জীবন মান উন্নত করতে কিছু কৌশল রয়েছে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন: হালকা ব্যায়াম ব্যথা কমাতে এবং ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন: নিয়মিত ঘুমের সময়সূচী অনুসরণ করুন এবং শান্তিপূর্ণ ঘুমের পরিবেশ তৈরি করুন।
স্ট্রেস কমান: ধ্যান, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা অন্যান্য আরামদায়ক কার্যকলাপ চেষ্টা করুন।
সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করুন: নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনে বিশ্রাম নিন।
উপসংহার
ফাইব্রোমাইলজিয়া একটি জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং অবস্থা, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে, অনেক রোগী একটি সার্থক এবং পূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন। যদি আপনি উপরে উল্লিখিত উপসর্গগুলি অনুভব করেন, তাহলে সঠিক নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য একজন যোগ্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। মনে রাখবেন, ব্যথা দৃশ্যমান না হওয়া সত্ত্বেও, আপনার অভিজ্ঞতা বাস্তব এবং চিকিৎসাযোগ্য।
ছবি- সাটারস্টক