চার বছরের জারিফ প্রায়ই রাতে পায়ে ব্যথা হচ্ছে বলে কান্না করে। কিন্তু দিনের বেলায় তার এই ধরনের কোন অনুযোগ থাকে না বলে তার মা এই ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু কাল থেকে সে হাঁটতে গেলেও ব্যথা পাচ্ছে বলার পর বিষয়টি নিয়ে জারিফের মা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে জারিফের মা কে চিকিৎসক বলেন এটা গ্রোথ পেইন। আসুন এবার জেনে নেই শিশুর গ্রোথ পেইন কী এবং এই সমস্যার আদ্যোপান্ত।
গ্রোথ পেইন কী?
শিশুরা যখন বড় হতে থাকে, বিশেষ করে ৩ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে, অনেক সময় তাদের পায়ের পেশি বা সন্ধিতে ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথাকে বলা হয় “গ্রোথ পেইন”। এটি কোনো গুরুতর রোগ নয়, বরং একটি সাধারণ শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়া। গ্রোথ পেইনের সময় ব্যথা সাধারণত দিনের চেয়ে রাতের বেলা বেশি অনুভূত হয় এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অনেক সময় ব্যথা থাকেই না।
যে কারণে গ্রোথ পেইন হয়ঃ
গ্রোথ পেইনের সঠিক কারণ সম্পর্কে এখনও বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। তবে কিছু কারণকে সম্ভাব্য বলে ধরা হয়:
১। পেশির ওপর অতিরিক্ত চাপ:
শিশুরা সাধারণত দিনব্যাপী খুবই সক্রিয় থাকে। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা বা লাফালাফির কারণে তাদের মাংসপেশি ও জয়েন্টে চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত চাপ অনেক সময় ব্যথার কারণ হতে পারে।
২। দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি:
শিশুর শরীরের হাড় ও পেশি যখন দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন পেশি ও হাড়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে কিছুটা সমস্যা হয়। ফলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৩। সঠিক ভঙ্গিতে চলাফেরা না করা:
যদি শিশু সঠিক ভঙ্গিতে না বসে বা না হাঁটে, তবে পেশি এবং হাড়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা ব্যথার কারণ হতে পারে। যেমন: ঘাড় ঝু্ঁকে পড়া বা মোবাইল দেখা, কুঁজো হয়ে বসা ইত্যাদি।
গ্রোথ পেইনের কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- ব্যথা পায়ের উরু, কাফ মাসল (পায়ের পেছনের অংশ) বা হাঁটুর আশপাশে অনুভূত হয়।
- ব্যথা সাধারণত রাতের বেলা বেশি হয় এবং সকালে কমে যায়।
- ব্যথা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় নাও থাকতে পারে।
- ব্যথা এত তীব্র হয় না যে শিশু স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না।
গ্রোথ পেইন থেকে পরিত্রাণের উপায়:
গ্রোথ পেইন কোনো গুরুতর সমস্যা নয়, তবে শিশুর ব্যথা কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
১। ম্যাসাজ:
ব্যথা কমানোর জন্য হালকা ম্যাসাজ খুবই কার্যকর। শিশুর পায়ের ব্যথার জায়গায় ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করুন।
২। গরম সেঁক:
গরম পানির ব্যাগ বা হিটিং প্যাড দিয়ে ব্যথার জায়গায় সেঁক দিন। এটি পেশি শিথিল করতে সাহায্য করে।
৩। ব্যায়াম:
শিশুকে হালকা স্ট্রেচিং বা ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন। এতে পেশি মজবুত হয় এবং ব্যথা কমে। প্রয়োজনে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।
৪। পেইন রিলিফ ক্রিম:
কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫। পর্যাপ্ত বিশ্রাম:
শিশুর শরীরের পেশি ও হাড় পুনর্গঠনের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম জরুরি।
চিকিৎসকের কাছে কখন যাবেন?
- যদি ব্যথার সাথে নিচের কোনও লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
- ব্যথা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে।
- ব্যথা এত তীব্র হয় যে শিশুর চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়।
- ব্যথার সঙ্গে অন্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন জ্বর, ফুলে যাওয়া, বা লালচে হয়ে যাওয়া।
গ্রোথ পেইন কমাতে শিশুর সঠিক যত্নঃ
১। সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা:
শিশুর খাবারে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও প্রোটিন নিশ্চিত করুন।এগুলো হাড় ও পেশি মজবুত করতে সাহায্য করে।
২। সক্রিয় জীবনযাপন:
শিশুকে খেলার মাধ্যমে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখতে উৎসাহিত করুন। তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। শিশু যেন পর্যাপ্ত ঘুমায় এবং বিশ্রাম করে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৩। সঠিক ভঙ্গি:
শিশু যেন সঠিকভাবে বসে, হাঁটে ও দৌড়ায়, তা নিশ্চিত করুন।
৪। জুতার সঠিক নির্বাচন:
শিশুর জুতা আরামদায়ক ও সঠিক মাপের হওয়া উচিত যেন তা পায়ে ব্যথার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
গ্রোথ পেইন একটি সাধারণ ও সাময়িক বিষয়, যা শিশুর বেড়ে ওঠার অংশ। যদিও এটি শিশুদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, তবে সঠিক যত্নের মাধ্যমে সহজেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিশুকে প্রয়োজনীয় ভালোবাসা ও সমর্থন দিন এবং তাদের আরামদায়ক রাখতে সচেতন থাকুন। প্রতিটি শিশুই বেড়ে উঠুক স্বাস্থ্যবান, সুরক্ষিত ও সুখী পরিবেশে।
লিখেছেন- মাহমুদা আক্তার রোজী
জেরিয়াট্রিক ফিজিওথেরাপিস্ট
ছবি – সাটারস্টক, সাজগোজ