আচ্ছা, চুলে নারিকেল তেল দেয়া কী খুবই জরুরী? (পর্ব - ০১) - Shajgoj

আচ্ছা, চুলে নারিকেল তেল দেয়া কী খুবই জরুরী? (পর্ব - ০১)

coconut-oil-thumbsnail

প্রশ্নটা বেসিকালি ১৩-৩০ বছর বয়সের নারী পুরুষের… কেন? মা বাবা চুলের লালচে আঠালো ভাব , আর ফেটে চৌচির হওয়া আগা দেখে রোজ ২-৩ বার বলবেন , কেন একটাবার মাথায় তেল দিচ্ছ না ? আর নিশ্চয়ই বারবার এটা শুনে বিরক্ত হননি এমন পাঠক খুব কমই আছেন? “আরেহ, আমার ক্লাস আছে, অফিস আছে, বাইরে যেতে হয় ,  তেল দিয়ে চপচপে হয়ে গেলে মানুষ হাসবে না ? উফ ১০ বার শ্যাম্পু করলেও তেল যায় না বাবা ! ”

অনেককে সরাসরি বলতেও শুনেছি ,

“তেল মেখে খ্যাত (!) হয়ে থাকতে ভালো লাগে না,
আমার চুল থাকবে সিল্কি, ফুরফুরে… ”

আমি তো টিন এইজের অনেকটা সময় এই মাইন্ড সেট নিয়েই ছিলাম… আমার মা ধরে বেধেও মাথায় এক ফোঁটা নারিকেল তেল দিয়ে দিতে পারতেন না… নিশ্চয়ই অনেকেই আছেন আমার মতো তাই না ?
“খ্যাত” হতে না চাওয়া একজন হিসেবে তাই প্রশ্ন করছি… নারিকেল তেল দেয়ার কি আসলেই দরকার আছে ? নাকি এটা শুধুই একটা মিথ… প্রাচীন কালের ভুল ধারণা ? তেল চপচপে না হয়েও সিল্কি ঘন কালো লম্বা চুল পাওয়ার কোন পরীক্ষিত শর্ট কাট কি আছে ? চলুন দেখি-

[picture]

ডিসক্লেইমার: আজকের লেখায় জ্ঞান দেব অনেক বেশি, আমি নিজে যেসব জিনিস বুঝতে পেরে খুব বিস্মিত হয়েছি, সেগুলো পাঠকদের জানানোই এর উদ্দেশ্য । জানি অনেকেই আসেন টিপস এবং শর্টকাটের জন্য । কিন্তু আমার মনে হয় , অন্ধভাবে কিছু ফলো না করে “কি করছি” ‘কেন করছি’ জানাটা আমাদের সবারই দরকার… আশা করি হেল্প হবে কিছুটা…

আজকের ব্যস্ত যুগের খুব পপুলার একটা জিনিস হচ্ছে , হেয়ার সিরাম , অনেক ব্র্যান্ড ড্রাই অয়েল নামেও বিক্রি করে এই জিনিস । ইন শর্ট , হেয়ার সিরাম প্রমিস করে , শ্যাম্পুর পরে একটু ভেজা চুলে ২-৩ ফোঁটা সিরাম আপনাকে দেবে সিল্কি চুল , যা সত্যিই হয় বটে , চুলের চেহারাই চেঞ্জ হয়ে যায় তাই না ? আমি ১৫-১৯ বছর বয়স পর্যন্ত টানা প্রতিবার শ্যাম্পুর পরে হেয়ার সিরাম ইউজ করেছি… আমাকে একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ডের খুব লয়াল কাস্টমার বলতে পারেন… বলাই বাহুল্য এত বছর আমি ভুলেও মাথায় তেল দেইনি… স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার নিয়ে একটু গভীরভাবে পড়াশোনা করার পর আমি বুঝতে শিখলাম – সিরাম , ড্রাই অয়েল, অনেক গুল ৫ মিনিট হেয়ার মাস্ক (মানে যা যা আমি দীর্ঘ ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারিকেল তেলের শর্ট কাট হিসেবে ব্যবহার করেছি, সেগুলো আসলে কীভাবে কাজ করে , জানতে চান?

কীভাবে কাজ করে সিরাম/ ড্রাই অয়েল/ অন্যান্য তেলের সাবস্টিটিউট ?

সত্যি কথা বলি, আমরা যত যাই বলি না কেন, সবারই মনে আশা থাকে টাকা দিয়ে একটা কসমেটিক কিনে ইউজ করে কিছু না কিছু একটা রেজাল্ট দেখা… হাজার টাকা খরচ করে ২-৩ বার ইউজ করে চুলে কোন চেঞ্জই দেখলাম না । মন খারাপ করার মতো একটা বিষয় । আপনি কি এমন প্রোডাক্ট দ্বিতীয় বার টাকা দিয়ে কিনবেন? – না ।

এখন বলুনতো এক্ষেত্রে কসমেটিক ব্র্যান্ডগুলো কি করবে ? মুনাফা করার জন্য তাদের দরকার এমন কোন প্রোডাক্ট , যা ২-৩ বার ইউজ করেই আপনি একটা রেজাল্ট দেখবেন … ফলাফল, দ্বিতীয় বার দোকানে গিয়ে আবার ওটাই কিনবেন… কাস্টোমার ধরে রাখাটাই ব্যাবসার চ্যালেঞ্জ । তাই না?

আপনি কি চান? – সিল্কি, ফুরফুরে চুল…

আপনি কি চুলের বাহ্যিক চেহারার উন্নতি করার জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় দিতে পারবেন ? – না

এখন আসি ব্র্যান্ডের কথায়-

২-৩ বার ইউজে দর্শনীয় সিল্কি চুল পেলে কি আপনি আবারো তাদের প্রোডাক্টই কিনবেন – হ্যাঁ

৪-৫ বছর পর আপনার চুলের কি অবস্থা হল সেটা নিয়ে কি চিন্তা করার দরকার ব্র্যান্ডের আছে- না

এখন , উপরের উত্তরগুলো সত্যি হলে- কমসময়ে কাজ করে, কিন্তু দীর্ঘ দিন ব্যবহারের উপযোগী নয় , এমন কোন উপাদান কি ব্র্যান্ড তাদের হেয়ার সিরাম ড্রাই অয়েলে ইউজ করতে পারে ?

হ্যাঁ, ৪-৫ বছর পর আপনার চুলের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজলেও মোস্ট লাইকলি, আপনি ভুলেও আপনার বিশ্বস্ত সিরাম-কে দোষ দেবেন না, তাই না ? এত দিনে তো আরও কতকিছুই হতে পারে । আর আপনার দেহের জন্য এসব উপাদান ক্ষতিকর নয়… সুতরাং, দোষ কি? ‘তেল মাখলে তুমি খ্যাত, তেল মাখলে স্মার্ট হওয়া যাবে না, ৩-৪ ঘণ্টা তেলের পেছনে না দিয়ে ৫ মিনিটে সিরাম/শ্যাম্পু/মাস্ক মেখে টিভি কমার্শিয়ালের মতো চুল পেয়ে যাও’- এসব হেডিং এর অ্যাড দেখিয়ে আপনার কাছে তেলের সাবস্টিটিউট বিক্রি করলে?

আপাত দৃষ্টিতে কোন দোষ নেই…তাই ভেবেছি, যতদিন তেলের বদলে, অমুক সিরাম, তমুক হেয়ার মাস্ক মেখেছি…  তেলের সাবস্টিটিউট হিসেবে বিখ্যাত কিছু ব্র্যান্ড অনেক প্রোডাক্টই মার্কেটে এনেছে, আমার নিশ্চয়ই নাম ধরে কিছু বলার দরকার নেই, বুঝতেই পারছেন…

এসব প্রোডাক্টের মেইন উপাদান মূলত দুটি- (১) সিলিকন  ,  (২) মিনারেল অয়েল, সিলিকনের পরিমাণই থাকে প্রচুর পরিমাণ… সিলিকন কি? – খুব সহজে বুঝিয়ে বলতে গেলে , এটা অনেকটা প্লাস্টিকের মতো । হাতের উপর প্লাস্টিকের গ্লোভস পরে যেমন হাত ভেজানো যায় না তেমনি সিলিকন খুব দ্রুত চুলের উপরে একটা নিশ্ছিদ্র আবরণ তৈরি করে যা ভেদ করা যায় না…

মিনারেল অয়েলও বেসিকালি সেইম কাজই করে, মিনারেল অয়েল এসব সিরামে কাজ করে বাহক হিসেবে, এতে খুব সহজে, বিভিন্ন সিলিকন যৌগ মিশিয়ে দেয়া যায়… বলাই বাহুল্য, দুটো উপাদানের দামই খুব কম । সো, প্রোডাক্ট তৈরিতে খরচ হয় না খুব বেশি…

একটু কাছ থেকে ব্যাপারটা বোঝা যাক – নিচের ছবিটি , মানুষের চুলের সেকশন, চুলের তিনটি অংশের নাম জেনে নিন-

coconut-oil pic 1

চুলের সবচেয়ে বাইরের অংশটার নাম হচ্ছে ‘কিউটিকল’ এর কাজ কি ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন।
আর নিচের ছবিটি একটি সাধারন চুলের, যাতে তেল, সিরাম কিছুই দেয়া হয়নি।

coconut-oil pic 2

চুলের বাইরের মাছের আঁশের মতন জিনিসগুলোই কিউটিকল… দেখতে কি এবড়োথেবড়ো লাগছে না? বলুনতো, এমন এবড়ো থেবড়ো একটা জিনিসের উপর, যেমন ধরি গাছের গুড়ি, তার উপরে আলো পড়লে কি আলো প্রতিফলিত হবে ? – না হবে না । কখনও হয় না ।

কিন্তু, জিনিসটা যদি খুব স্মুদ হয় ? যেমন- সিল্কের কাপড়/ কাঁচ ? কি আলো ঠিকরে চলে আসবে ? – হ্যাঁ ।

সিল্কের কাপড়ে সবসময় একটা চকচকে ভাব থাকে তাই না ?

আমরা কি চাইছিলাম মনে আছে তো ?

– চুলটা চকচক করুক তাই তো? সেটাকেই তো সিল্কি বলে… যা দেখতে সিল্কের মতন…

কি মনে হচ্ছে ? কোনভাবে যদি এবড়ো থেবড়ো কিউটিকল-গুলো সমান করে দেয়া যায় তাহলেই তো চুল চক চক করবে… রাইট? – হ্যাঁ, অবশ্যই ।
এই কাজটা করার একটা সহজ উপায় হল –

চুলের উপরে পলিথিনের মতো কিছু একটা জড়িয়ে দিলাম… সেটাও স্মুদ । কিউটিকল গোল্লায় যাক… তার লাইনে আশার দরকার নেই। আমার চুল সিল্কি হলেই হল । তাই তো?

আমি সেটাই করলাম… চুলে ২-৩ ফোঁটা সিরাম মেখে নিলাম । চুলের উপরে সিলিকনের একটা আস্তর পড়ে গেল… খুবই মসৃণ আস্তর । চুলে এখন আলো পড়লেই তা ঠিকরে যাবে । চুল লাগবে সিল্কি… খুব সহজ সমাধান… আরও মজার ব্যাপার- এবড়ো থেবড়ো সুতা ফেলে রাখলে তাতে জটা তো পাকাবেই তাই না ? কিন্তু সুতা গুলো যদি সিল্কের হয় ? খুব স্মুদ হওয়ার কারণে জটা তেমন লাগে না । পিছলে পিছলে যায় তাই না ? আর এটা চুলের জন্যও সত্যি । চুলটাকে পিচ্ছিল বানিয়ে ফেললে চুলে জটা লাগাও কমে যাবে তাই না ? –ঠিক তাই? এক ঢিলে দুই পাখি…
সিলিকনের লেয়ার দেয়া চুলের অবস্থাটা হয় এরকম-

coconut-oil pic 3

আগের থেকে স্মুদ না ? সিলিকনের কোটিং এ কিউটিকলের আঁকাবাঁকা হওয়ার জো নেই…

কতো হেয়ার সিরামের অ্যাড দেখেছেন, চুলে চিরুনি পিছলে যাচ্ছে এমন দেখাচ্ছে বলুনতো? বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সিরাম মাখার পর আমার চুলে খোপা করেও রাখা যেত না । চুল এতই সিল্কি যে খোপা খুলে যেত (!!) আমি তো মহাখুশি… !!!

কি পরিচিত লাগছে ? এমনটা অনেকেই দেখেছেন নিশ্চয়ই?

মজার ব্যাপার হল , কিছুদিন যখন আপনি পরপর এসব সিলিকনে ভরা সিরাম ইউজ করেন , একটা ঘটনা ঘটে , সেটা হল- একবার শ্যাম্পুতে সব সিরাম ধুয়ে যায় না … এবড়োথেবড়ো কিউটিকলের ফাঁকে তারা আটকা পড়ে থাকে… আর আমরা সপ্তাহে ৩-৪ বার শ্যাম্পু করে সিরাম মাখি… প্রতিবারই সিলিকন জমা হতে থাকে এভাবে জমতে জমতে চুলের বাইরে মোটামুটি পার্মানেন্ট একটা সিলিকন লেয়ার পড়ে যায়…

আর তখন কিছু ঘটনা ঘটে-
১। চুলের উপরে রেইনকোট চলে আশায় , চুলে পানি ঢুকতে পারে না,  এমনকি যখন গোসল করছেন তখনো না ।

coconut-oil pic 4
নরমাল চুলে এমনটা হয়, চুলের ভেতরে কিছু পানি থাকে, যখন আপনি গোসল করেন বাইরে থেকে পানি এসে চুলের আদ্রতা বজায় রাখে… আর চুলের উপরে সিলিকন আর মিনারেল অয়েলের আস্তর পড়ে থাকলে কি হয় দেখি-

coconut-oil pic 5

সবুজ কণাগুলো সিলিকন, কি করছে সে দেখতে পাচ্ছেন? কিউটিকলের ফাঁকায় চলে গিয়ে বাইরে থেকে পানি আসার পথ বন্ধ করে দিচ্ছে…

২। ফলাফল, চুলের ভেতরে আদ্রতা না ঢুকতে পারার কারণে চুলের ভিতরের ‘কর্টেক্স’ অংশ শুকাতে থাকে, এবং দুর্বল হতে শুরু করে । চুলের কিউটিকল-গুলো আগে একটু এবড়ো থেবড়ো হয়ে থাকতো, এখানে সেখানে সিলিকন জমে এখন সে পুরই উদ্ভ্রান্ত হয়ে যায়… এই অবস্থাকে আমরা বলি,  ‘চুলটা রুক্ষ হয়ে গেছে’

৩। এমনকি মাথার নিজের তৈরি করা সেবাম, যা চুলের কিউটিকল গুলো গুছিয়ে রেখে চুলকে সত্যিই স্মুদ করে, সেটাও চুলকে ছুঁতেও পারে না…
দীর্ঘদিন এসব প্রোডাক্ট ব্যবহারের পর চুলের চেহারা হয় নিচের ছবির মতো –

coconut-oil pic 6
কি? অবস্থাটা কি আগের থেকে ভালো নাকি খারাপ?

চুলের অবস্থা যখন এমনটা হয় তখন কি কি হয় জানেন?

ধরুন আপনি এসব প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন, একদিন শ্যাম্পু করলেন, কিন্তু শ্যাম্পুর পরে সেদিন সিরাম দিলেন না, তখন চুল শুকানোর সাথে সাথে দলা পাকিয়ে যাবে… কোন ভাবেই দলা ছাড়াতে পারবেন না। চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিলে আঙ্গুল আটকে যাবে এমন অবস্থা… চুল ছাড়া রেখে বাইরে গেলে তো সর্বনাশ, বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে গেলে একবার সেই ভুতের মতো চুলের জটা ছাড়াতে চুল টেনে টেনে ছেড়া ছাড়া গতি থাকবে না…

এই চুলের আমাদের দেশে একটা স্পেশাল নাম আছে, তা হল- চুল আঠা হয়ে যাওয়া।
উপসর্গগুলো চেনা চেনা লাগছে? রোজ কতো প্রশ্ন দেখি, ‘আপু, চুল আঠা আঠা হয়ে থাকে, কতো যত্ন নেই… কিন্তু চুলে চিরুনি দিলেই চুল ছেড়ে, চুল পড়ে…’ – আপনার নিজের কি কখনও এই কথাগুলো মনে হয়েছে?

একবারে অনেক বেশি কথা বলে ফেলছি… লেখার প্রথম পর্ব শেষ করব কিছু সহজ প্রশ্ন দিয়ে, আচ্ছা, আমরা তেল, হারবাল ঘরোয়া মাস্ক মাখি কেন আসলে? ওই জিনিসে থাকা পুষ্টিগুলো যেন চুলের মধ্যে গিয়ে চুল শক্ত, মজবুত করতে হেল্প করে তাই না ?

স্কিনের ডাক্তাররা বলেন- এসব জিনিস চুলের উপরের লেয়ারটা স্মুদ করে, চুলের ভেতরে গিয়ে শক্তি দেয়… কীভাবে? সেটা নিয়ে পরের পর্বে আলাপ করব…

কিন্তু এখন বলুনতো- আমার চুলের উপরে একটা প্লাস্টিকের লেয়ার পড়ে আছে, এসব ঘরোয়া মাস্ক/ তেল/ পানি কি আমার চুল ছুঁতে পারবে? যদি ছুঁতে না পারে, তাহলে প্লাস্টিকে মোড়ানো চুলে মেহেদি, ডিম, কলা, আমলকী মাখা কি উলুবনে মুক্তা ছড়ানো হয়ে যায় না?

লিখেছেন – তাবাসসুম মিম

আচ্ছা, চুলে নারিকেল তেল দেয়া কী খুবই জরুরী? (পর্ব – ০২)

3 I like it
0 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort