ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স এ আপনার শিশুটি ভুগছে না তো?

আপনার শিশুটি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সে ভুগছে না তো?

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স থাকায় শিশুটি দুধ খাচ্ছে না

১২ বছরের শান্ত। ওর মা ওকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন আজকাল। ও দুধ বা দুধের তৈরি কিছুই খেয়ে হজম করতে পারছে না। হয় বমি করে ফেলে দিচ্ছে না হয় হজমে সমস্যা না হলে পাতলা পায়খানা। একটা না একটা সমস্যা হচ্ছেই। ডাক্তারের কাছে নেবার পর ডাক্তার সব দেখে শুনে যা বললেন, তাতে তো শান্ত’র মায়ের আক্কেল গুড়ুম! শান্ত’র নাকি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স আছে! দুধ কিংবা দুধ দিয়ে তৈরি কিছু ওকে দেয়া যাবে না। মায়ের তো মাথায় হাত। এখনতো ওর বাড়ন্ত বয়স। দুধ না খেলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি বা ক্যালসিয়াম কোথা থেকে পাবে? এইরকম সমস্যা অনেক শিশুরই হয়ে থাকে। তবে ভয়ের কিছু নেই। ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স খুব মারাত্মক কোন সমস্যা না। শুধু একটু বুঝে শুনে চললেই হল। চলুন জেনে নিই শিশুর ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সে করণীয় নিয়ে বিস্তারিত।

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স কী?

এটি এমন এক সমস্যা যেখানে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ল্যাক্টেজ  নামক এনজাইম উৎপাদিত হয় না। এই এনজাইম এর কাজ হল দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার এর মধ্যে থাকা ল্যাকটোজ-কে ভেঙে এটি দুই ধরনের সুগার তৈরি করে-  গ্লুকোজ এবং গ্যালাক্টোজ। মানবদেহ তখন এই সুগার-গুলোকে শোষণ করে আমাদের শরীরে থাকা ইন্টেস্টাইন এর সাথে মিশিয়ে দেয়। যখনি এই ল্যাক্টেজ এনজাইম-এ ঘাটতি দেখা দেয়, এটা আর ঠিকমতো ল্যাকটোজ-কে ভাঙতে বা শোষণ করতে পারে না। তখনি দেখা দেয় ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স। উল্লেখ্য, গ্লুকোজ-এর অনেক উৎস আছে, কিন্তু গ্যালাক্টোজ-এর একমাত্র উৎস হল দুধ। বিশেষত মায়ের দুধ-এ গরুর দুধ বা ফর্মুলার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ ল্যাকটোজ থাকে।

ল্যাকটোজ টলারেন্স ও ইন্টলারেন্স - shajgoj.com

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স আর মিল্ক অ্যালার্জি কি একই?

না, দুটো এক নয়। অনেক বাবা-মা’ই দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন। ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হল হজমগত সমস্যা। আর মিল্ক অ্যালার্জি রোগ প্রতিরোধ  ক্ষমতায় কোন সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। তাই দুটো এক নয়।

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স ও মিল্ক অ্যালার্জি এর পার্থক্য - shajgoj.com

লক্ষণ যদিও ক্ষেত্র বিশেষে এক হয়ে থাকে কোন কোন সময়ে। যেমন- দুধ বা দুগ্ধজাত কিছু খেলেই  পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি। তবে ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স মারাত্মক কোন সমস্যার দিকে ঠেলে দেয় না। পক্ষান্তরে, মিল্ক অ্যালার্জির ঠিক মতো চিকিৎসা না হলে তা ‘অ্যানাফিলেক্টিক শক’ নামে প্রাণঘাতী অসুখের কারণ হতে পারে। তাই যদি দেখেন দুধ বা দুধের তৈরি কোন কিছু খেলেই বাচ্চার ঠোঁট ফুলে গেছে বা র‍্যাশ হয়েছে, চুলকাচ্ছে- তাহলে বুঝতে হবে ওটা মিল্ক অ্যালার্জি

কোন কোন বাচ্চার আবার দুধ এর স্বাদ বা গন্ধ সহ্য হয় না। ওটাও কিন্তু ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স না।

দুধ - shajgoj.com

আরেকটা বড় পার্থক্য হল, মিল্ক অ্যালার্জি থাকলে সাধারণত তা শিশুর প্রথম বছর থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স সাধারণত শিশুদের একদম জন্ম থেকেই হচ্ছে, এমনটা অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।

১) প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স

সাধারণত, একটু বড় হবার পর বা কৈশোরে এই সমস্যা ধরা পড়লে, একে প্রাইমারি ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স বলে। সাধারণত প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-টাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যেখানে ল্যাক্টেজ শরীরের সাথে প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে আসে। প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স মূলত দেখা যায় আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে। বয়সের সাথে সাথে আবার প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স কমেও আসে, কারণ ততদিনে দুধের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসে এবং আর বহুবিধ খাবারে আমাদের শরীর অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

২) সেকেন্ডারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স

সেকেন্ডারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-এর বেলায়, অনেক সময়ে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল ইনফেকশন, সার্জারি বা দীর্ঘ অসুখের পর শরীরে দুধ সহ্য হয় না। তখন শরীরের ধরন বুঝে একটু পানি মিশিয়ে পাতলা করে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

নানা ধরণের ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স - shajgoj.com

৩) জন্মগত ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স

এমনটা খুবই বিরল সমস্যা যে বাচ্চা জন্ম থেকেই দুধ একদম সহ্য করতে পারছে না বা খেলেই যন্ত্রণা পাচ্ছে, ডায়রিয়া হয়ে যাচ্ছে বা বমি করে ফেলছে।  এসব ক্ষেত্রে যা হয়, তার জন্য দায়ী হল জীনগত সমস্যা। বাবা বা মায়ের কাছ থেকে এই সমস্যা বংশগত ধারায় বাচ্চাও পেয়ে থাকে, ফলে শিশুর শরীরে ল্যাক্টেজ হরমোন থাকে পুরোপুরি অনুপস্থিত। মায়ের দুধে অনেক বেশি ল্যাকটোজ থাকে আগেই বলেছি, এমনকি ল্যাকটোজযুক্ত ফর্মুলা  খেলেও বাচ্চা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এই ধরনের ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে যখন ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা এবং ইলেক্ট্রোলাইট-এর ভারসাম্যহীনতার কারণে  শিশুর জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।

৪) বিকাশগত ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স

আরেকটা কারণে ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হতে পারে, তা হল শিশু যদি প্রিম্যাচিওর হয়। সাধারণত শরীরে ল্যাকটেজ এনজাইমা তৈরি হয় মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় ৩৪ সপ্তাহ বয়স থেকে। সেটা ব্যাহত  হলে পরবর্তীতে এদের মাঝে ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-এর  প্রবণতা দেখা দেয়।

লক্ষণ

  • দুধ বা দুধ এর তৈরি কিছু খেলে পেটে ব্যথা হওয়া বা পেট ফুলে যাওয়া।
  • দুধ খাওয়ানোর সময়ে শিশুর ছটফট করা।
  • ওজন বৃদ্ধি না পাওয়া।
  • দুধের শিশু, অথচ দুধ খাওয়ানোর পর-ই ডায়রিয়া
  • গ্যাস হওয়া।
  • বমি এবং পাতলা পায়খানা হওয়া।

এই সমস্যা নির্ণয় করা যায় কীভাবে?

এই সমস্যা ধরতে চিকিৎসকেরা নানান ধরনের পরীক্ষা করে থাকেন।  যেমন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয় যে উচ্চ ল্যাকটোজ সমৃদ্ধ তরল খাবার খাওয়ার পর শরীরে কেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আরেকটা হল হাইড্রোজেন ব্রিদ টেস্ট, উচ্চ ল্যাকটোজ সমৃদ্ধ তরল খাবার খাওয়ার পর দেখা হয়ে থাকে যে নিঃশ্বাসের সাথে কতখানি হাইড্রোজেন নিঃসরণ হচ্ছে। যদি ল্যাকটোজ পুরোপুরি হজম না হয়, তবে নিঃশ্বাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে। আবার শিশুদের বেলায় যেটা করা হয়, তা হল স্টুল এসিডিটি টেস্ট, যেখানে শিশুদের মলের স্যাম্পল নিয়ে দেখা হয় তাতে ল্যাকটিক এসিড এর পরিমাণ কতখানি। ল্যাকটিক এসিড তৈরি হয় তখনি, যখন শরীরের ইন্টেস্টাইন গ্রন্থি হজম না হওয়া ল্যাকটোজ সুগার-কে ব্যাকটেরিয়ায় পরিণত করে।

শিশুর ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সে কি করণীয়?

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স শিশুদের একদম জন্ম থেকে হচ্ছে, এমনটা অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়; তবু যদি এর ব্যতিক্রম হয়? যদি অল্প বয়সেই ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হয়? বাচ্চাকে কি খাওয়াবেন? চিন্তায় পড়ে গেলেন তো? দুধ তো সবচেয়ে ভালো সুষম খাদ্য। ওটাই যদি বাড়ন্ত বয়েসের বাচ্চাকে খাওয়ানো না গেল, তাহলে ওর বিকাশ হবে কি করে?

ভয়ের কিছু নেই। ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হল ডায়েট থেকে দুধ এবং দুধের তৈরি খাবার একদম কমিয়ে দেয়া বা বাদ দিয়ে দেওয়া। কেননা শরীরে ল্যাকটোজ বাড়ানোর কোন ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো পাওয়া যায়নি। সয়া মিল্ক খেতে পারেন অনায়াসে, শরীরে ল্যাকটোজের ঘাটতি পূরণের জন্য। আর ক্যালসিয়াম এর ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ডিম, মাছ, মাংসর পাশাপাশি খেতে হবে পালং শাক, সবজি এবং ফল। সহজ কথায়, বাচ্চার খাবারের টিপস, ট্রিক্স এবং রেসিপি মাথায় রাখুন।

ডিম মাছ মাংস ফল - shajgoj.com

তা না হলে শরীরে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন –ডি, রিবফ্লাভিন, বা প্রোটিন এর অভাব দেখা দেবে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খেতে পারেন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট। নবজাতক বাচ্চাদের এই সমস্যা থাকলে তাদেরকে দিতে হবে ল্যাকটোজ ফ্রী ফর্মুলা। বড় বড় সুপারস্টোর গুলোতে সহজেই কিনতে পাবেন এটা। বুক এর দুধ একদম না।

আবার ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু অনেকেই আধা কাপ এর মতো দুধ কোন সমস্যা ছাড়াই খেয়ে হজম করতে পারেন। আর দুধ এর তৈরি কিছু খাবার কিন্তু আছে, যাতে উচ্চমাত্রার ল্যাকটোজ নেই। যেমন পারমিসিয়ান চীজ, চেড্ডার চীজ, অথবা টকদই অল্প করে খেলে সমস্যা নেই।

চীজ টক দই - shajgoj.com

কিছু কিছু খাবার এ কিন্তু দুধ থাকে, যা না জেনেই আমরা সেগুলো খেয়ে থাকি, যেমন ইনস্ট্যান্ট সুপ, সালাদ ড্রেসিং, সস, সিরিয়েল, বেকিং মিক্স ইত্যাদি। তাই এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।

ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স প্রতিরোধ যোগ্য সমস্যা না। আবার সবসময়ে এটা চিরস্থায়ীও হয়, এমন নাও হতে পারে। তবে এটা কারও মাঝে যে মাত্রাতেই থাকুক না কেন, খাদ্যগ্রহণে একটু সচেতন হলেই পুরোপুরি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে আপনার আদরের সোনামণিকে বড় করে তোলা সম্ভব।

ছবি – টুইটার.কম, পিন্টারেস্ট.কম, সাটারস্টক

 

9 I like it
0 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort