বুলিং | কতটুকু নিরাপদ আমাদের জীবন? - Shajgoj

বুলিং | কতটুকু নিরাপদ আমাদের জীবন?

bullying

খুবই সুন্দর একটি কিশোরী মেয়ে। পড়ছে নবম শ্রেণীতে। নাম তার অপ্সরা। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো কিন্তু অনেক চুপচাপ ও শান্ত প্রকৃতির। কেউ এসে তার সাথে মিশলে সেও মন থেকেই খুব সুন্দরভাবে আপন করে নেয়। কিন্তু ক্লাস-এর কেউ আসলে অপ্সরাকে বন্ধু বানানোর উদ্দেশ্যে মিশতো না। সবাই তার সম্পর্কে জানার কৌতূহল থেকে মিশতো। এরপর ক্লাস এর ছেলে-মেয়েগুলো তাকে নিয়ে পিছনে পিছনে নানা রকমের আজে বাজে কথা বলতো এবং তাকে উপেক্ষা করে চলতো। তখন অপ্সরার খুব একাকীত্ব বোধ হতো আর নিজেকে অপরাধী ও অভিশাপ মনে করতো। খুব কষ্ট পেত মনে মনে। অপ্সরার কিন্তু আসলে কোন দোষই ছিল না। কিছু মানুষের সাথে অকারণেই এমন সব ঘটনা ঘটে থাকে। সেটার সামান্য একটি কারণ হল তারা সবার থেকে একটু ভিন্ন হয়ে থাকে।

একদিন ক্লাস এর ছেলে-মেয়েগুলো ব্রেক টাইম-এ অপ্সরাকে অনেক উত্যক্ত করলো। তার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিলো, তার টেবিল এ পানি ঢেলে দিলো, টিফিন বক্সটি-ও কেড়ে নিলো। অপ্সরা এরপরও চুপচাপ সবকিছু সহ্য করলো।

আরেকদিন গণিত বাড়ির কাজের খাতাটি লুকিয়ে ফেললো ক্লাস-এর ছেলে-মেয়েগুলো। অপ্সরা গণিতে দুর্বল ছিল। সেদিন গণিত শিক্ষক এর কাছে অপ্সরা হাতে অনেকগুলো বেতের বারি খেলো।

এভাবে দিন যেতে যেতে মেয়েটি মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়তে থাকে। তার স্কুলে যেতে একদমই ভালো লাগে না। আবার সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষার অনেক চাপ তার মাথায়। তার মানসিক অবস্থার কথা কাউকে বলতেও পারছে না। তার মা-বাবাও খুব একটা আন্তরিক ছিল না, তার তেমন কোন ভালো বন্ধুও ছিল না। ভিতরে ভিতরে মেয়েটি প্রতিনয়ত মরছিল। তার মনে হত কেউ তার অবস্থাটা বুঝবে না, এমনকি বাবা-মাও না। অপ্সরার পড়ালেখা দিনে দিনে অনেক অবনতি হতে থাকে। মানসিকভাবেও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার আত্মবিশ্বাস দিন দিন হারাতে থাকে।

এভাবেই কাউকে অপমান করা, আত্মসম্মানে আঘাত করা, দোষারোপ করা, হুমকি দেওয়া, উত্যক্ত করা অথবা মানসিক ও শারীরিকভাবে অন্যদের দ্বারা আক্রমণ হওয়াকে বলা হয়বুলিং’। বুলিং-এর আচরণগুলি মৌখিক আতঙ্ক , শারীরিক আক্রমণ বা জোরজবরণ আরো নানা ধরনের উত্যক্তমূলক আচরণের অন্তর্ভুক্তি হতে পারে। বুলিং অন্যদের অশালীন ও অমানসিক আধিপত্য ব্যবহার। এই  আচরণ প্রায়ই পুনরাবৃত্ত এবং অভ্যাসগত হয়। বুলিং-এর শিকার হয়ে মানুষ সামাজিক বা শারীরিক ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা হারিয়ে ফেলে। এই ধরনের আধিপত্য, এই ধরণের আচরণের মাঝে সামাজিক শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, যৌন অভিযোজন, চেহারা, আচরণ, শরীরের ভাষা, ব্যক্তিত্ব, খ্যাতি, বংশ, শক্তি, আকার বা ক্ষমতা মানুষের ভিন্ন ধরন ও অন্যদের থেকে পার্থক্যগুলো থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়। বুলিং সমাজের একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, বুলিং-এর কারণে কিশোর-কিশোরীরা অনেকেই আত্মহত্যা করছে এবং এবিসি নিউজ, উইকিপিডিয়া-এর পরিসংখ্যান রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে ৩০% ছাত্র-ছাত্রীরা বুলিং-এর শিকার হয়ে তারা স্কুলে যাচ্ছে না, তাদের মধ্যে অনেক ভয়ভীতি ও বিষণ্ণতা কাজ করে। ১৩-২৩ বছর যুবক-যুবতীরা আত্মহত্যার উপর বেশি প্রলোভিত থাকে। বুলিং তাদের জীবনে অনেক বাজে প্রভাব ফেলছে। মানসিক ও সামাজিক ব্যাপ্তির উপর নেগেটিভ প্রভাব পরছে। তারা জীবন থেকে অনেক পিছিয়ে পরছে অথবা অনেকে নিজের জীবন ত্যাগ করে দিচ্ছে। মা-বাবা হারাচ্ছে তাদের আদরের সন্তান। জীবন থেমে যাচ্ছে এই কিশোর বয়সেই। বুলিং-এর সমস্যাটি এশিয়াতে দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশেও। বুলিং-এর শিকার তারাই হয়ে থাকে যারা সাধারণত অন্যদের থেকে একটু ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। বুলিং অনেক ধরনের হতে পারে-

  • শারীরিক
  • মৌখিক
  • সম্বন্ধযুক্ত
  • সাইবার-বুলিং
  • সমষ্টিগত
  • প্রতিবন্ধকতা
  • পারিবারিক
  • ইভটিজিং
  • অ্যাডামটিজিং… আরো নানা ধরনের।

বুলিং প্রতিরোধে করনীয়

১) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পরিবারে, কর্মস্থলে বা যেকোথাও যখনি কেউ বুলিং-এর শিকার হবে, শুরু থেকেই সেটার প্রতিবাদ করতে হবে, নাহলে এটি ক্রমশ বাড়তেই থাকবে।

২) বাবা-মায়েদের তাদের সন্তানের সাথে অনেক বন্ধুত্বসুলভ আচরণ থাকতে হবে এবং তাদের প্রতিদিনের খোঁজ খবর নিতে হবে। সন্তানের দিনটি কেমন ছিলো সেটা জানতে হবে আর সেই অনুযায়ী পরামর্শ দিতে হবে।

৩) বাবা-মায়ের স্কুলের শিক্ষকগণদের সাথে সব-সময় যোগাযোগ থাকতে হবে, সন্তানের সব ধরনের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য এবং খোলাখোলি আলোচনা করতে হবে।

৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বুলিং-এর বিরুদ্ধে কড়াকড়ি ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৫) শিক্ষকদের বুলিং-এর ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সাথে এটার প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

৬) মিডিয়া যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র- এসবে বুলিং প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

বুলিং আমাদের সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। এই সমস্যাটির সমাধান ও প্রতিকার না করা হলে, যুব সমাজ ও কিশোর-কিশোরীরা জীবনের একটি সুষ্ঠ-শৃঙ্খল পথ থেকে সরে যাচ্ছে। জড়িয়ে  যাচ্ছে নেশার সাথে, কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ মানসিকভাবে আর স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। নষ্ট হচ্ছে আমাদের সমাজ। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সবার উচিত বুলিং-এ শিকারগ্রস্থদের বাঁচাতে এবং যারা বুলিং করে তাদের মানসিকতা বদলাতে পদক্ষেপ নেওয়া  । সময় এখনই!

লিখেছেন- নিকিতা বাড়ৈ

ছবি- টেড.কম

6 I like it
0 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort