টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক | কেমন হবে আপনার ব্যবহার?

টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক | কেমন হবে আপনার ব্যবহার?

টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক

“তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, কী করো তুমি সারাদিন? ভালো স্কুল, কোচিং, হাউজ টিউটর- কিছুই তো বাদ রাখিনি, তারপরও তোমার পড়ায় মনোযোগ নেই! গানের ক্লাসেও যাও না! ছবি আঁকা তো মনে হয় ভুলেই গিয়েছো। তোমার রফিক আঙ্কেলের ছেলে এবারও ক্লাসে প্রথম হয়েছে, আর তুমি দিন দিন গোল্লায় যাচ্ছো। আর রোকেয়া ভাবীর মেয়ে গান গেয়ে কত প্রাইজ পায়, তুমি কী করলে গান শিখে?” কি? কথাগুলো খুব পরিচিত লাগছে? প্রিয় পাঠক, এই কথাগুলো জীবনে কোনো না কোনো পর্যায়ে হয় নিজে শুনেছেন অথবা পরিচিত কোনো টিনেজকে শুনতে দেখেছেন। অবশ্যই অভিভাবক সন্তানের ভালো চান, কিন্তু তাদের চাওয়াটা যখন সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় অথবা অভিভাবকের চাওয়াটা যখন সন্তানকে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করে, ঠিক তখনই হিতে-বিপরীত হয়। চলুন জেনে নেই, টিনেজ সন্তানের সাথে অভিভাবকের সম্পর্ক কেমন হবে তার কিছু টিপস।

টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক

টিনেজার বলতে আমরা ১৩-১৯ বছরের বাচ্চাদের বুঝি। ৬-৭ ঘণ্টা একজন টিনেজার স্কুল/ কলেজে থাকছে এবং এখানে বিভিন্ন পরিবেশ-পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সাথে মিশছে। আবার এই বাচ্চাটিই যাচ্ছে গানের, নাচের, ছবি আঁকার অথবা ক্যারাটে ক্লাসে। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার সন্তানটি কিছু না কিছু শিখছে। যাদের সাথে মিশছে তাদের কাছ থেকেও কিছু না কিছু শিখছে। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা যা শিখছে সব যে ভালো তা কিন্তু নয়, আবার সব যে খারাপ শিখছে তাও নয়।

টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক

প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। সব বাচ্চা কিন্তু এক রকম নয়, কেউ হয়তো খুব সাবলীলভাবে সব উপদেশ গ্রহণ করছে এবং কাজে লাগাচ্ছে। কেউবা পারছে না, কারোবা ইচ্ছে করছে না করতে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন কেন এমন হচ্ছে আপনার সন্তানটির সাথে? কেন সে পরীক্ষায় খারাপ করছে অথবা আগে যেই কাজটি করতে ভালবাসতো, আপনার সন্তানটি এখন কেন আর সেই কাজে আগ্রহ পাচ্ছে না? আদৌ কি কাছে বসিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছেন, কোথাও কি কোনো সমস্যা হচ্ছে তার? হয়তো করেছেন উত্তর পাননি, হয়তো ভেবেছেন করবেন কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি জিজ্ঞেস করার।

আমার আজকের লেখাটি সেই সব বাবা-মায়ের জন্য যারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, কীভাবে আপনার টিনেজ সন্তানের সাথে মানসিক সম্পর্ক দৃঢ় করবেন। টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক ভালো করার উপায় সম্পর্কেই আজকে আপনাদের জানাবো।

১) মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে বোঝা 

সাধারণত বয়ঃসন্ধির সময় হরমোন ও শারীরিক পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তির ব্যবহারেও বেশ পরিবর্তন আসে। বয়ঃসন্ধির সময় যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তাও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটায়। চলমান শারীরিক পরিপূরক প্রক্রিয়া শিশুদের চাহিদা, আগ্রহ এবং মেজাজ পরিবর্তন করার জন্য সরাসরি শরীর ও মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। চিন্তা করে দেখুন, আপনার ছেলেটি- যার ত্বক ছিল কোমল, গলার স্বর ছিল স্বাভাবিক, হঠাৎ তার গলার স্বর হয়ে গিয়েছে ভারী, মুখে দাড়ি উঠেছে অথবা আরও কিছু শারীরিক পরিবর্তন এসেছে। ঠিক তেমনই শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে আপনার মেয়ে সন্তানটিরও। যেই মেয়েটি আগে হয়তো খুব হই-হুল্লোড় করে বেড়াতো, সেই মেয়েটি তার নিজের পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না। শারীরিক পরিবর্তনটি আপনি চোখে দেখছেন, মানসিক পরিবর্তন কি দেখতে পারছেন?

আপনি হয়তো দেখছেন আপনার সন্তানটি হঠাৎ করে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছে, আপনার বেশিরভাগ কথাতে  রিয়্যাক্ট করছে, অনেক সময় মিথ্যা বলছে কিছু নিয়ে, কোনো বিষয় লুকাচ্ছে, যেই বন্ধুদের সাথে হয়তো আপনি বলছেন কম মিশতে তাদের সাথেই বেশি মিশছে, তর্ক করছে কারণে অকারণে। একই বাড়িতে থেকে মানসিকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সন্তানের সাথে। পরিবার ও সহকর্মীদের সাথে আপনার সন্তানের সম্পর্কের নাটকীয় পরিবর্তন এবং বদল আপনাকে হয়তো ভাবাচ্ছে কিন্তু আপনিও হয়তো বুঝতে পারছেন না কী করবেন। টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখতে আপনাদের এই সম্পর্কে জানতে হবে।

কিশোর বয়সীদের রাগ

২) সহজে হতাশ না হওয়া 

আপনি হয়তো লক্ষ্য করবেন যে আপনার সন্তান তার পরিবারের সাথে কম সময় ব্যয় করতে চায় এবং তার বন্ধুদের সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে চায়। কিশোর বয়সে বাবা-মায়েদের এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক, কারণ শিশুরা তখন আরও স্বাধীনতা চায়। কিশোর বয়সে অতিরিক্ত মেজাজ দেখানোর অন্যতম একটি কারণ হলো, তাদের মস্তিস্ক ও শারীরিক পরিপক্বতা। শিশুদের ২০ বছরের মধ্যে যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়, এই অসম্পূর্ণ মস্তিষ্কের উন্নয়নগুলি মানসিক অস্পষ্টতার জন্য দায়ী, যার জন্য বাবা-মা সহজে হতাশ হতে পারেন।

মাতা-পিতাকে তাদের সন্তানদের এই অপ্রাপ্ত মস্তিষ্কের গঠন, ঘুম পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত হরমোন এবং মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে হবে। আপনার হয়তো মনে হতে পারে যে, আপনার সন্তান এখন আপনার থেকে ভিন্নভাবে কিছু দেখতে শিখছে। একটা ১৪/১৫ বছরের ছেলে বা মেয়ের কাছ থেকে আপনি কিন্তু পরিপূর্ণ বয়সের মানুষের ব্যবহার আশা করতে পারেন না। যে ছেলে বা মেয়েটি নিজেই সন্দিহান তার পরিবর্তনগুলো নিয়ে, তার কাছ থেকে পরিপক্ক ব্যবহার আশা করাটা কি বোকামি না?

পরিবার, মা-বাবা কিন্তু সন্তানের সবচেয়ে আস্থার জায়গা। এই কথাটি আপনার কিশোর বয়সের সন্তানের কাছে বোধগম্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুধু কথায় না বরং কথায় ও কাজের সংমিশ্রণে সন্তানকে এই ব্যাপারটি বোঝান। আপনার  কিছু বন্ধু সুলভ আচরণই পারে আপনার প্রিয় সন্তানটির জীবনের এই কঠিন সময়টিকে সুন্দর করে তুলতে।

৩) বিশ্বস্ত সম্পর্ক তৈরি করা 

ট্রাস্ট বা বিশ্বাস যে কোনো সম্পর্কের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার কিশোর সন্তানকে আপনার কথা শোনাতে চান, তাহলে আপনাকেও কিন্তু তার কথা শোনার সময় ও ধৈর্য্য থাকতে হবে। আপনাকে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। একটি খোলা সম্পর্ক রাখুন সন্তানের সাথে, যেখানে আপনারা একে অপরের সাথে কিছু ভাগ করতে পারেন। যখন আপনি আপনার জীবন এবং কাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো আপনার কিশোর সন্তানের সাথে ভাগ করেন, তখন আপনার সন্তান জানবে যে আপনি তাকে গুরুত্ব দেন এবং তার জীবনের বিষয়ে সে আপনার সাথে খোলাখুলি কথা বলতে পারে।

সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক

৪) সহানুভূতিশীল হওয়া 

মনে রাখবেন, আপনিও কোনো একসময় কিশোর ছিলেন। আপনার কিশোর আচরণের অনুভূতির অভাবনীয় ব্যাপারগুলো কল্পনা করুন এবং ভাবুন যে আপনার কিশোর সন্তানটি কেমন অনুভব করছে, তাদের দৃষ্টিকোণ বুঝতে চেষ্টা করুন। যখন আপনি সন্তানদের অনুভূতিকে বুঝতে পারেন, তখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের অনুভূতি, ধারণা এবং মতামতকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

৫) সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া 

আপনি কি চান আপনার কিশোর সন্তান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোক এবং সেই শ্রদ্ধা হোক ভালোবাসার? তবে আপনিও তাদের সম্মান করে এই বিষয়টি শেখান। শুধু ভয়, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, সব শখ পূরণের ব্যবস্থা – কখনো সম্মান এনে দিতে পারে না। সন্তানের ব্যক্তিত্ব, ধারণা, মতামত এবং আবেগ অনুভব করুন এবং সম্মান দিন। তাদের বন্ধুদের সামনে, কেউ সামনে না থাকলেও তাদের নিন্দা করবেন না এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাদের মতামতকে তুচ্ছ বা সমালোচনা করবেন না। এতে তারা নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে পারে। যখন আপনি আপনার সন্তানদের অসম্মান করে কথা বলবেন বা আচরণ করবেন, তখন তারাও আপনার প্রতি একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। টিনেজ সন্তানের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে আপনাদের এই দিকগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে।

৬) সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করা 

বেশিরভাগ কিশোর কিশোরী নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে পছন্দ করে এবং মনে করে কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তাদের জানা প্রয়োজন যে আপনি তাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক। তাদের যে কোনো প্রয়োজনে আপনি পাশে আছেন বন্ধুর মতো। সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপনি কখনো কঠোর হতে পারেন কিন্তু কঠোরতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সন্তান ভুল বুঝবে আপনাকে। আপনার অতিরিক্ত শৃঙ্খলা এবং কঠোরতা দেখে তারা বিশ্বাস করতে পারে যে আপনি শুধুমাত্র তাদের জন্য জীবনকে কঠিনই করতে চান। তাদের বলুন আপনি তাদের ভালোবাসেন এবং জীবনে শৃঙ্খলা থাকা দরকার সবারই।

সন্তানের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক

টিনেজ সন্তানদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে এবং অনুশীলনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাদের যথেষ্ট সংখ্যক সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। টিনএজ সন্তানের আচরণ নিয়ে যদি আপনার চিন্তা থাকে তাহলে অবশ্যই সন্তানের সাথে কথা বলুন। সন্তান কথা বলতে না চাইলে তাকে কিছুটা সময় দিন। যদি মানসিক টানাপোড়েন বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারেন।

 

ছবি- সাটারস্টক

 

65 I like it
6 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort