ট্যুরিজম এবং বাংলাদেশ | একজন ভ্রমণ প্রদর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি - Shajgoj

ট্যুরিজম এবং বাংলাদেশ | একজন ভ্রমণ প্রদর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি

Untitled

“পাখিদের দিকে তাকিয়ে ফুটবল ভাবে, যেহেতু উড়ছে, তার মানে ওকেও কেউ না কেউ নিশ্চয়ই লাথি মেরেছে! কিন্তু পাখিরা উড়ন্ত ফুটবলকে দেখে কি ভাবে? “যাহ বাবা! এ তো ডিম থাকতেই উড়তে শিখে গেছে!” কি ভাবছেন? হুট করে আবার কৌতুক শেয়ার করতে বসেছি কেন? কৌতুকটি লেখার পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ আছে। আজ যে মানুষটিকে নিয়ে কথা বলব, কৌতুক বিষয়টি তার জীবনের সাথে খুব গভীরভাবে জড়িত!

বলছিলাম কায়েশ খানের কথা। মিরাক্কেল ৬-এ বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা এ বহুমুখী প্রতিভার মানুষটির কথা মনে আছে কি আপনাদের? গম্ভীরমুখে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক বলে যাওয়া সেই কায়েশ খানকে নিয়েই আজ ক্যারিয়ার সেকশানের আলোচনা। পেশায় তিনি মূলত একজন ভ্রমণ প্রদর্শক। এ বিষয়ক আলোচনার জন্যই আজ তাকে সাজগোজের এই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। বাংলাদেশের ট্যুরিজম সেক্টর এবং ট্যুরিজম পেশার খুঁটিনাটি নিয়ে চলুন জেনে নিই তার কাছ থেকে জরুরি কিছু কথা।

সাজগোজ টিমের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা। নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।

ধন্যবাদ। আমি কায়েশ খান। নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে শিক্ষাজীবন নিয়ে বলতে চাই। আমি এসএসসি পাশ করেছি আমার জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর থেকে এবং এইচএসএসসি পাশ করেছি ঢাকার সরকারি তিতুমির কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশান নিয়ে ট্র্যাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেশানের উপর ন্যাশনাল সার্টিফিকেট কোর্স করার জন্য ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেইনিং ইন্সটিট্যুট (এনএইচটিটিআই) –এ ভর্তি হয়ে সফলভাবে তা সম্পন্ন করি। ১৯৯৯ সালে ‘দ্য গাইড ট্যুরস’ নামে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ট্যুর অপারেটিং কোম্পানিতে ট্যুর গাইড ও ট্র্যাভেল ডেস্ক অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে যোগ দিই। ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমি এখানে কাজ করেছি। ২০০৬ সালে আমি ‘এক্সকারশন অ্যান্ড রিসোর্টস বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে আরও একটি জনপ্রিয় ট্যুর অপারেটিং কোম্পানিতে অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিই এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত এখানে কাজ করি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের জি বাংলার জনপ্রিয় কমেডি শো ‘মিরাক্কেল’ এ অংশ নেয়ার জন্য এখানকার চাকরিটি ছেড়ে দিই। প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ার আগে আমি শীর্ষ ৫ প্রতিযোগীদের তালিকায় একজন ছিলাম। ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় আবারও ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও ট্যুরিজম পেশাটির প্রতি আমার অঙ্গীকার বজায় রাখতেই তা প্রত্যাখ্যান করি। কলকাতায় আমি ৭ মাসের মত ছিলাম। বাংলাদেশে যেহেতু অক্টোবর মাসে ট্যুরিস্ট সিজন শুরু হয়, আমাকে তাই শো থেকে বিদায় নিয়ে নিজের পেশায় ফিরে আসতে হয়। আসলে আমি কখনই ঠিক কমেডিয়ান ছিলাম না। কিন্তু মিরাক্কেলের অডিশানে সুযোগ পেয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারাটা অবশ্যই আমার জন্য খুব প্রীতিকর একটি অভিজ্ঞতা ছিল। কমেডি বিষয়টি আমার এক ধরণের প্যাশন এবং সারাজীবনই আমি তা পারফর্ম করে এসেছি। নিজের সহকর্মী এবং আশেপাশের সবাইকে হাসাতে আমি খুব ভালবাসি। জি বাংলা এবং মিরাক্কেলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, কারণ তাদের জন্য আজ আমার একটি তারকাখ্যাতি তৈরি হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে প্রচুর বন্ধু ও অনুসারী পেয়েছি।

বর্তমানে আমি ‘জার্নি প্লাস’ নামক বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচে থাকা একটি ট্যুর কোম্পানিতে সিনিয়র ট্যুর ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছি এবং বেশিরভাগ সময়ে আমি বিদেশি পর্যটকদের সাথে ভাষান্তরিক হিসেবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াই। বিশ্বের প্রায় ৪০ টিরও বেশি দেশের অতিথি/পর্যটকদেরকে আমি ভ্রমণ প্রদর্শন সেবা দিয়েছি এবং এই সেক্টরের পেশাকে আমি উপভোগ করি অনেক। ট্যুরিজম ব্যক্তিত্ব হিসেবে বলা যায়, অন্যদের ছুটির দিন হল আমার কর্মদিবস। এটাকে পেশাদারী দুর্ভোগও বলা যায় যেহেতু আমাকে ঈদ কিংবা এ ধরণের উৎসবগুলোর দিনেই কাজ করতে হয়। মাঝেমধ্যে উৎসবের দিনগুলোতে আমি সত্যিই আমার পরিবার ও কাছের মানুষগুলোকে খুব মিস করি।

Untitled5

শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়ায়

ট্যুর গাইড হতে চাওয়ার পেছনের গল্পটি কী?

আসলে ছেলেবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখার। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝতে পারলাম, পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখাটা খুব সহজ নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বিশ্বের সমস্ত কোণ থেকে আসা মানুষদেরকে ট্যুরিজম সেবা প্রদান করব!

ট্যুরিজম সেক্টরে আপনার যাত্রা শুরু হল কিভাবে?

এনএইচটিটিআই ডিপ্লোমা শেষ করে আমি ‘দ্য গাইড ট্যুরস’ থেকে চাকরির অফার পেলাম এবং সুযোগটি লুফেও নিলাম।

নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডে বর্তমান সময়গুলো কেমন যাচ্ছে? সব প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে?নাকি ভবিষ্যতের জন্য আরও কোন পরিকল্পনা আছে?

সিনিয়র ট্যুর ম্যানেজার হিসেবে বর্তমানে যে সম্মানী পাচ্ছি তা আমার জন্য যথোপযুক্তই এবং নিয়মিত বিদেশি পর্যটকদের সাথে ঘুরে বেড়ানোটাও সমান তালে উপভোগ করছি। সবদিক থেকেই ফার্স্ট ক্লাস আছি বলা যায়! বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বিদেশি পর্যটকদের সাথে আমার ১৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বাংলাদেশে এখনও সুদক্ষ ট্যুর গাইডিঙের অভাব রয়েছে। আর তাই এ সেক্টরে ক’জন দক্ষ ট্যুর গাইড তৈরি করার একটি পরিকল্পনা আমার রয়েছে। সেটি করার জন্য আমি নিজের একটি ব্যবসা গড়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হবে ট্যুর কোম্পানিগুলোকে সুলভে দক্ষ ও উপযুক্ত ট্যুর গাইড প্রদান করা, যা এক ধরণের গাইড ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।

Untitled

বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বিদেশিপ র্যটকদের সাথে

পর্যটন পেশায় এ পর্যন্ত কী কী সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে? সেগুলোর সমাধানই বা কীভাবে হয়েছে?

প্রধান একটি সমস্যা হচ্ছে ভ্রমণ বিষয়ক বই ‘লোনলি প্ল্যানেট’। কারণ, বাংলাদশের ভৌগোলিক অবস্থা খুব দ্রুত বদলায়, কিন্তু বই হালনাগাদ করা হয় না। পর্যটকরা সাধারণত বই থেকেই তথ্য নিয়ে থাকেন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবের সাথে তার কোন মিল থাকে না। এই সমস্যা মোকাবিলায় একজন প্রদর্শকের যথেষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যেন বইয়ের তথ্যগুলোর চেয়ে তার কথার ওপরেই পর্যটক বেশি আস্থা রাখে। এছাড়া আরও কিছু সমস্যা হল হুটহাট কৌতুহলী মানুষদের উতপাত এবং আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিচ্ছন্নতার অভাব।

বাংলাদেশের পর্যটন খাতে মূলত কী কী অন্তরায় রয়েছে এ খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে?

আমাদের দেশে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয় না এবং সরকারি বাজেটেও এ খাত তেমন কোন সুবিধা পায় না। তাছাড়া ট্যুর অপারেটরাও সেবা পরিবেশক যেমন রেন্ট-এ-কার, হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টগুলোর কাছে কোন ধরণের সুযোগ-সুবিধা, ছাড় কিংবা কমিশান পায় না। ব্যতিক্রম কেউ কেউ আছেন অবশ্য।

আপনার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ট্যুরিজম খাতে কী কী ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?

আমাদের সময়ে কেউ ট্যুর গাইডের চাকরিকে পেশা হিসেবে বাহবা দিত না। সেই পরিস্থিতি এখন খানিকটা বদলেছে।

এই খাতেবাংলাদেশের সম্ভাবনাসমূহ কী কী বলে আপনার ধারণা?

প্রধানত, আমাদের সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষজন, কায়িক শ্রম এবং দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ!

একজন সফল ট্যুর গাইড হতে গেলে কী কী গুণ থাকা আবশ্যক?

ট্যুর গাইডকে হতে হবে সময়নিষ্ঠ, মনযোগী এবং প্রায় সর্ববিষয়ে জ্ঞানী। বিশেষ করে সব খাতের পরিসংখ্যান নিয়েই বেশ ভাল জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কারণ তাকে নিজের দেশ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে অনেকটা নিজের ডান হাতের মতই। তাছাড়া অতিথি পর্যটকের দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কেও খুব ভাল ধারণা থাকাটা জরুরি। ভবিষ্যত ট্যুর গাইডদের জন্য কিছু পরামর্শ দিন। একজন ট্যুর গাইড হলেন তার নিজ দেশের একজন প্রতিনিধি। আপনি যদি নিজের দেশকে বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষদের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী থাকেন, তাহলে পর্যটন খাতে আপনাকে স্বাগতম!

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

 সাজগোজ টিমকেও অনেক ধন্যবাদ ।

 সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেনঃ নুজহাত ফারহানা

1 I like it
1 I don't like it
পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort